নির্মল চন্দ্র সাহা বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য
রেফারেন্স : [2010] 30 BLD 584
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
বাদী : নির্মল চন্দ্র সাহা
বিবাদী : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য
ঘটনা :
আপিলকারী নির্মল চন্দ্র সাহা অভিযোগ করেন যে, প্রবীর দেব নাথ, সঞ্জয় মজুমদার, বিশ্বনাথ দেবনাথ ও মানিক লাল দেবনাথ তার কন্যা কণামিকা ওরফে কণা সাহাকে অপহরণ করেছেন। সে তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তদন্ত শেষে, পুলিশ প্রবীর দেব নাথের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৭ ধারায় চার্জশিট জমা দেয়।
প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগী কণামিকার নিরাপদ হেফাজতের লক্ষ্যে তাকে লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগারে রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়। হেফাজতকালীন সময়ে, রেডিওলোজী এক্সরে পরীক্ষায় তার বয়স ১৫ বছর বলে পরিলক্ষিত হয়। তবে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ২২-এর অধীনে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দেয়া জবানবন্দিতে সে তার বয়স ১৯ বছর বলে উল্লেখ করে এবং জানায় যে সে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছিলো এবং ১৭ মার্চ, ২০০৯-এ বিবাহ করেছেন। একই সাথে ,সে তার স্বামী এবং শ্বাশুড়ির সঙ্গে স্বামীর বাড়িতে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
উক্ত জবানবন্দির ভিত্তিতে, ৪ মে, ২০০৯-এ লক্ষ্মীপুর দায়রা জজ আদালত তার পিতার হেফাজতের আবেদন খারিজ করে দেন। পরবর্তীতে, ১৬ জুলাই, ২০০৯-এ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল তাকে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে অবস্থিত নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রে স্থানান্তরের আদেশ প্রদান করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে, নির্মল চন্দ্র সাহা হাইকোর্ট বিভাগে আপিল আবেদন করেন যে, সাবালকত্ব আইন, ১৮৭৫ অনুযায়ী কণামিকা এখনও নাবালিকা, ফলশ্রুতিতে, কণামিকার হেফাজত তার অধীনে থাকা উচিত।
ইস্যু :
১. সাবালকত্ব আইন এবং অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনের অধীনে নাবালিকা বিবেচনা করে কণামিকার অভিভাবকত্ব তার পিতাকে প্রদান করা উচিত কি না?
২. স্বামী ও শ্বাশুড়ির সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশের বিষয়টি কি কণামিকার অভিভাবকত্বের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করবে?
৩. হিন্দু আইনানুযায়ী, কণামিকার বৈবাহিক অবস্থা এবং তার স্বামীর বর্তমান কারাবাসের বিষয়টি বিবেচনা করে, তার স্বামী বা স্বামীর পরিবারের কাছে অভিভাবকত্ব প্রদান করা উচিত কি না?
যুক্তিতর্ক :
আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী জনাব হুমায়ুন হোসেন খান যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, কণামিকার স্কুল রেকর্ড এবং এস.এস.সি. প্রবেশপত্র অনুযায়ী, তার জন্ম তারিখ ১ এপ্রিল, ১৯৯৩, যার ফলে তার বর্তমান বয়স ১৭ বছরের কম এবং সাবালকত্ব আইন, ১৮৭৫ অনুযায়ী তিনি একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক। তিনি উল্লেখ করেন যে, অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ অনুযায়ী তার বাবা, তার বৈধ অভিভাবক হিসেবে তার হেফাজতের অধিকারী। বিজ্ঞ আইনজীবী আরো বলেন, অভিভাবকত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর ইচ্ছার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক। আব্দুল মজিদ সরকার (মো.) বনাম রাষ্ট্র ও শ্রী মঙ্গল চন্দ্র নন্দী বনাম বাংলাদেশ মামলাগুলিতে আপিল বিভাগের ঘোষিত রায়ের বিষয়টি উল্লেখ করেন, যেখানে হেফাজতের দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে পিতাকে সবচেয়ে যোগ্য হিসেবে উল্লেখ করে রায় প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও, তিনি বলেন, শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি) এর ১২ নং অনুচ্ছেদ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ বাংলাদেশ সিআরসি তে স্বাক্ষরিত দেশ হলেও এটি দেশীয় আইনের অংশ নয় এবং দেশীয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে।
প্রতিপক্ষের আইনজীবী সৈয়দা আনোয়ারা সাত্তার, এ যুক্তি প্রদান করেন যে, হিন্দু আইনের অধীনে, একজন নাবালিকা স্ত্রীর অভিভাবকত্ব বিয়ের মাধ্যমে স্বামীর নিকট স্থানান্তরিত হয়। তিনি উল্লেখ করেন যে, শিশু আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী, বিদ্যালয়ের রেকর্ডে উল্লিখিত জন্মসালের ভিত্তিতে কণামিকা নাবালিকা নয়। কারণ, উক্ত আইনে ১৬ বছরের নিচের ব্যক্তিদের নাবালক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তিনি আরো যুক্তি দেন যে, জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে, অনুচ্ছেদ ১২(১) এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত, যা কণামিকার স্বামী এবং শাশুড়ির সাথে থাকার ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেয়। তিনি উল্লেখ করেন, হিন্দু নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব আইন, ১৯৫৬ (একটি ভারতীয় আইন) এর ৬(গ) ধারা অনুসারে, স্বামী তার নাবালিকা স্ত্রীর উপর অভিভাবকত্বের অধিকারী।
সিদ্ধান্ত :
আপিল আবেদনটি মঞ্জুর করা হয়েছিল।
দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পর হাইকোর্ট বিভাগ সরাসরি ভুক্তভোগী কণামিকা সাহার বক্তব্য শোনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আদালতকে কণামিকা জানায় যে, তার বাবার বাড়িতে তার একজন অবিবাহিত বড় বোন রয়েছে, যে ইতঃপূর্বে তাকে মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতন করেছে। নির্যাতনের এই ভীতির কারণে সে তার বাবার বাড়িতে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক। তবে কণামিকা সাহা আদালতকে জানায় যে, যদি তার বোন পূর্বের ন্যায় নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকে তবে সে তার বাবার বাড়িতে ফিরে যেতে ইচ্ছুক।
তার বক্তব্য পর্যালোচনা করে, আদালত জানান যে, একজন হিন্দু বিবাহিত নারীর হেফাজতের অধিকার তার স্বামীর উপর বর্তায়, যদিও তিনি নাবালিকা হন। কণামিকার ক্ষেত্রেও, তার হেফাজতের দায়িত্ব তার স্বামীর নিকট প্রদান করা হতো কারণ তিনি বিবাহিত নারী। তবে, যেহেতু তার স্বামীর কারাগারে ছিলেন ফলশ্রুতিতে স্বামীর নিকট হেজাফতের অধিকার প্রদান করা হয়নি।
পিতৃগৃহে শারীরিক ও মৌখিক নির্যাতনের ঘটনার প্রেক্ষিতে আদালত নির্ধারণ করেন যে, পিতামাতার নিকট কণামিকার হেফাজত প্রদান, তার জন্য কল্যাণকর হবে না। ফলশ্রুতিতে, তার শারীরিক নিরাপত্তা এবং শিক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে, আদালত কণামিকার হেফাজতের অধিকার বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএনডাব্লিউএলএ)-কে ন্যস্ত করেন ও বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করেন এবং ছয় মাসের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। উক্ত শর্তের প্রেক্ষিতে আদালত কণামিকাকে তার পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
- ধারা : ৭, ২২
- সাবালকত্ব আইন, ১৮৭৫
- অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০
- শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি)
- অনুচ্ছেদ : ১২
- শিশু আইন, ১৯৭৫ (রহিতকরণ)
- ধারা : ২ (চ)
- হিন্দু নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব আইন, ১৯৫৬
- ধারা : ৬ (গ)
অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান
২. রুদ্র জয়া
৩. ইমরান হোসেন ইমন
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ