বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট এবং অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ (শুকুর আলী কেইস)
রেফারেন্স : 68 DLR (AD) [2016]
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
বাদী : বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ও অন্যান্য
বিবাদী : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
ঘটনা :
১৯৯৯ সালের ১১ই জুন, মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার টেপরা গ্রামে নিজ বাসার বারান্দায় সাত বছর বয়সী সুমি আক্তার তার সমবয়সি আরো দুজন শিশুর সাথে খেলাধুলা করছিলো। আনুমানিক দুপুর ২ টা ৩০ মিনিট থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অবশেষে শুকুর আলীর (বাদী) তালাবদ্ধ ঘর থেকে শিশু সুমির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার পরিহিত গহনাগুলো সেখানে ছিল না। তার পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল এবং গোপনাঙ্গের চারিপাশে লালচে তরল পদার্থের আলামত পাওয়া যায়। টেপরা গ্রামের লোকজন শুকুর আলীকে আটক করলে তিনি সুমি আক্তারকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ এর ৬(২) ধারায় অভিযুক্ত শুকুর আলীকে বিচারপূর্বক দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যেখানে উল্লেখ্য, ❝যদি ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণের পরে মৃত্যু হয় তাহলে অভিযুক্ত ধর্ষকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।❞ উক্ত ধারানুযায়ী, আলীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করা হয়। যদিও আলী দাবি করেন যে, সরকার কর্তৃক নিযুক্ত আইনজীবী তার পক্ষের সাক্ষ্যপ্রমাণ শুনানির সময় আদালতের সামনে সঠিকভাবে উত্থাপন করেন নি। অতঃপর, আদালত কর্তৃক ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়।
শুকুর আলীর বিচার ও অভিযুক্ত হওয়ার আগেই, ১৯৯৫ সালের আইনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ কর্তৃক প্রতিস্থাপিত হয়েছিলো। যেখানে বলা হয়, ❝উক্ত অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবে।❞ সেখানে এটিও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ১৯৯৫ সালের আইনের অধীনে সংঘটিত যে কোনো অপরাধের বিচার ও দণ্ড ১৯৯৫ সালের আইন অনুযায়ী করা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখে।
ইস্যু :
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মানদণ্ডে, কোন সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান পরিবর্তন বা পুনঃবিবেচনা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
সিদ্ধান্ত :
আপিল বিভাগ বলেন, যদিও মৃত্যুদণ্ডের বিধান একটি সাংবিধানিক বিধান তবুও কোন অপরাধের জন্য ❝বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান❞ অসাংবিধানিক কারণ, বাধ্যতামূলক শাস্তির বিধান কোন ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, ধরণ, অভিযুক্তের বয়স ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে আদালতের বিচক্ষণতার মাধ্যমে শাস্তি নির্ধারণের স্বকীয়তাকে খর্ব করে। ফলস্বরূপ, নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ এর ধারা ৬(২) এবং এরূপ অন্য আইন যেখানে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড প্রদানের নির্দেশ রয়েছে সেই সকল আইন সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক।
উক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আদালত আন্তর্জাতিক বেশকিছু নীতিমালা অনুসরণ করেন, যার মধ্যে ছিল মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮ এর ৫ নং অনুচ্ছেদের ❝অমানবিক, নিষ্ঠুর বা অপমানজনক শাস্তি নিষিদ্ধকরণ❞ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি, ১৯৬৬ এর ৬ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ❝ইচ্ছামতো জীবন হরণ না করার অধিকার❞ যা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ নং অনুচ্ছেদেও প্রতিফলিত হয়েছে। আদালত ব্লাস্ট-এর উপস্থাপিত এ যুক্তি সমর্থন করেন যে, যখন অভ্যন্তরীণ আইনে কোন বিষয় অস্পষ্ট বা নীরব থাকে, তখন জাতীয় আদালতগুলোর আন্তর্জাতিক বিধানের সহায়তা নেয়া উচিত। এর মধ্যে ছিল বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডকে স্বেচ্ছাচারী হিসাবে বিবেচনা করা, কারণ এটি বিচারকের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে।
অধিকন্তু, আদালত শুকুর আলীর সাজাকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করেন, কেননা ১৯৯৫ সালের আইনটি ২০০০ সালের আইনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিলো, যেটি বিচারপতিদের আরও বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার প্রদান করে। আদালত ইসলামিক আইনও উল্লেখ করেন, যেখানে জীবনকে পবিত্র বলে গণ্য করা হয় এবং দয়া প্রদর্শনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আরো উল্লেখ করা হয় যে, আইনসভা কর্তৃক বাধ্যতামূলক সাজা প্রদানকারী আইন প্রণয়নের ব্যাপারটি আদালতকে শুধু ❝আইন প্রণেতাদের রাবার স্ট্যাম্প❞-এ পরিণত করে এবং অপরাধের সময় সংশ্লিষ্ট সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ন্যায়সংগত রায় প্রদানের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে।
অতঃপর, আদালত বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন, কারণ বাধ্যতামূলক শাস্তির বিধান বিচার বিভাগকে অপরাধ এবং অপরাধীর সাথে সম্পর্কিত পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে। সর্বোপরি, যদিও ১৯৯৫ সালের আইনের ধারা ৬(২) অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল, আদালত শেষ পর্যন্ত শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ডকে পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং অপরাধের ভয়াবহতা স্বীকার করে একটি ন্যায়সংগত এবং উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেন। সাজা কমানোর বিষয়ে আপিল করা হয়েছিলো বিধায় আলী’র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর দুইমাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিলো।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, ১৯৬৬
- অনুচ্ছেদ : ৬
- মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮
- অনুচ্ছেদ : ৫
- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
- অনুচ্ছেদ : ৩২, ৩৫(৩), ৩৫(৫)
- নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫
- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধন ২০০৩)
- শিশু আইন, ১৯৭৪
অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান
২. ফাহিম আহমেদ
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ