কাজী মোখলেসুর রহমান বনাম বাংলাদেশ এবং অন্যান্য
রেফারেন্স : 26 DLR (AD) 44
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
আবেদনকারী : কাজী মোখলেসুর রহমান
বিবাদী : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
ঐতিহাসিক পটভূমি :
মামলার মূল বিরোধ ছিল পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বেরুবাড়ী কে কেন্দ্র করে, যা বেরুবাড়ী ইউনিয়ন নং ১২ নামেও পরিচিত, যার আয়তন ছিল ৮.৭৫ বর্গমাইল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সেই সময় বাংলা প্রদেশকেও পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) এবং পশ্চিম পাকিস্তান (ভারতের অংশ) হিসেবে ভাগ করা হয়। এই বিভাজনের জন্য স্যার সিরিল জন র্যাডক্লিফ কে প্রধান করে বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত কমিশন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করে এবং র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড তৈরি করে। র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড অনুযায়ী বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ এর দক্ষিণাংশ (২.৬৪ বর্গমাইল) পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু পরে জানা যায় যে পুরো বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয় নিয়ে পাকিস্তান সরকার তৎকালীন সময়ে কোনো আপত্তি জানায় নি।
পরবর্তীতে দেখা যায় যে, ভারতের ১১১ টি ছিটমহলের পূর্ব পাকিস্তানের আর পূর্ব পাকিস্তানের ৫১ ছিটমহল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা মে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টার ডোমিনিয়ন কনফারেন্স, ১৯৪৮’ এ দুই দেশের মধ্যবর্তী ছিটমহল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ই ডিসেম্বর উক্ত কমিটি সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ করে। তদুপরি, “ইন্দো-পাকিস্তান সীমানা নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল” গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে শুনানি চলাকালীন, দুই রাষ্ট্রের কেউই বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ নিয়ে কোন প্রকার আপত্তি জানায় নি। ১৯৫০ সালে ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদান করেন।
দুই বছর পর পাকিস্তান বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে। পাকিস্তান দাবি করে যে, র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড অনুসারে, বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২-এর দক্ষিণ অংশ (২.৬৪ বর্গ মাইল) পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পরবর্তীতে ভুলক্রমে ভারতের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের মাঝে ১৯৫৮ সালে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে বলা হয় যে, “বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২-এর দক্ষিণ অংশ (২.৬৪ বর্গ মাইল) পাকিস্তানকে প্রদান করা হবে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের সকল ছিটমহল ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা পাকিস্তানের ছিটমহলগুলো পাকিস্তানের নিকট হস্তান্তর করা হবে।” তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ পাকিস্তানের নিকট হস্তান্তরের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ফলশ্রুতিতে, ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩(১) অনুযায়ী উক্ত বিষয়ে আইনি মতামতের জন্য বিষয়টি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নিকট প্রেরণ করা হয়, যা বেরুবাড়ি ইউনিয়ন কেস, ১৯৬০ নামে পরিচিত। সুপ্রিক কোর্টে রায় প্রদান করেন যে , “বেরুবাড়ি সহ অন্যান্য বিষয়ে র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ডে অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে এবং বেরুবাড়ি সম্পর্কিত চুক্তিটি অ্যাওয়ার্ড অনুযায়ী হয়েছে বলে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।” আদালত জানান যে, বেরুবাড়ি ভারতের অংশ এবং উক্ত চুক্তি ‘ভারতের ভূখণ্ড একটি বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট সমর্পণের সমতুল্য।’ পরবর্তীতে, ভারতের সংবিধানের ১(৩)(গ) এবং ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে, “উক্ত চুক্তি কার্যকর করতে আইনসভাকে নতুন করে আইন পাস করতে হবে। শুধু সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের অধীনে আইন প্রণয়ন করেই এই চুক্তি কার্যকর করা যাবে না, বরং সংবিধানের ৩৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে। তবেই কেবল ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ এর অধীন উক্ত চুক্তিটি কার্যকর হবে।” ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে, ১৯৬০ সালে ভারতের সংবিধানের ১ এবং ৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ৯ম সংশোধনীর মাধ্যমে এই চুক্তিকে আইনি বৈধতা প্রদান করা হয়।
পরবর্তীতে, দুই দেশের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বের কারণে ১৯৬৫ সালে ‘ইন্দো-পাক যুদ্ধ’ শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে, বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২-এর দক্ষিণ অংশ পূর্ব পাকিস্তানের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি এবং ছিটমহলগুলোর বিনিময়ও হয়নি। ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধের পর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এর ফলে, পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২-এর দক্ষিণ অংশসহ ছিটমহল বিরোধের সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে, বেরুবাড়ি ইউনিয়ন, ছিটমহল এবং অন্যান্য সীমান্ত নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে “মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়।
ঘটনা :
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়-
“ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নম্বর ১২-এর দক্ষিণাংশ এবং সংলগ্ন ছিটমহলগুলোর প্রায় ২.৬৪ বর্গমাইল এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিবে এবং এর বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও আঙ্গারপোতা ছিটমহলের নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে। ভারত চিরস্থায়ী ভিত্তিতে বাংলাদেশকে ‘তিন বিঘা’-এর নিকটে ১৭৮ মিটার × ৮৫ মিটার একটি এলাকা ইজারা দেবে, যা দহগ্রামকে বাংলাদেশের পাটগ্রাম থানার পানবাড়ি মৌজার সঙ্গে সংযোগ করবে।”
ছিটমহল সম্পর্কিত চুক্তিতে বলা হয়েছিল-
“বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত ভারতের সব ছিটমহল এবং ভারতের ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশের সব ছিটমহল যত দ্রুত সম্ভব পারস্পরিক বিনিময় করা হবে।”
পরে, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী কাজী মোখলেসুর রহমান এই চুক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(আ) অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন (রিট আবেদন নং-৫৫৯/১৯৭৪) দায়ের করেন, যা ‘রিট অব সার্টিওরারি’ নামে পরিচিত।
অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(আ) অনুযায়ী –
“(২) হাইকোর্ট বিভাগের নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আইনের দ্বারা অন্য কোন সমফলপ্রদ বিধান করা হয় নাই, তাহা হইলে
(ক) যে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে-
(আ) প্রজাতন্ত্র বা কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিষয়াবলির সহিত সংশ্লিষ্ট যে কোন দায়িত্ব পালনে রত ব্যক্তির কৃত কোন কার্য বা গৃহীত কোন কার্যধারা আইনসংগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে করা হইয়াছে বা গৃহীত হইয়াছে ও তাঁহার কোন আইনগত কার্যকরতা নাই বলিয়া ঘোষণা করিয়া
উক্ত বিভাগ আদেশদান করিতে পারিবেন; “
কাজী মোখলেসুর রহমান উল্লেখ করেন যে, এই চুক্তিটি সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদকে প্রভাবিত করেছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল –
“২) প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে- (ক) ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখের স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যাহতি পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব-পাকিস্তান গঠিত ছিল;”
কাজী মোখলেসুর রহমান যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, ১৯৫৮ সালের চুক্তি অনুসারে ‘বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২’-এর দক্ষিণ অংশের ২.৬৪ বর্গমাইল এলাকা ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর অংশ ছিল। তাই, বাংলাদেশের সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে এই এলাকাটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। অতএব, উক্ত ভূমি ভারতের কাছে হস্তান্তর করা অসাংবিধানিক। তাই, তিনি আদালতের কাছে অনুরোধ করেন যে, এই চুক্তি যথাযথ আইনি কর্তৃপক্ষ ব্যতীত সম্পাদিত হয়েছে এবং চুক্তিটির কোন প্রকার আইনি বৈধতা নেই বলে ঘোষণা করা হোক। কিন্তু উচ্চ আদালত রিট আবেদনটি “প্রিম্যাচিউর” (যথা সময়ের পূর্বে করা আবেদন) বলে মন্তব্য করে তা সরাসরি খারিজ করে দেন।
উক্ত বিষয়ে, ১৯৫৮ সালের চুক্তিতে কোনো শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তবে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে একটি অতিরিক্ত শর্ত যোগ করা হয়েছিল, যা ছিল :
“এই চুক্তি বাংলাদেশ এবং ভারতের সরকার কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পাদিত হবে এবং অনুমোদনের দলিলাদি যত দ্রুত সম্ভব পারস্পরিক বিনিময় করা হবে। অনুমোদনের দলিল বিনিময়ের তারিখ থেকে এই চুক্তি কার্যকর হবে।”
উক্ত চুক্তি স্বাক্ষরের পরেই রিট আবেদন দায়ের করা হয়। তবে, এই চুক্তিতে উভয় দেশের সরকারের অনুমোদনের শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা নির্দেশ করে, চুক্তিটি এখনো কার্যকর হয়নি। এই শর্তের ভিত্তিতে, উচ্চ আদালত বলেন –
“এই চুক্তি এখনো সম্পন্ন হয়নি, অতএব, এই মুহূর্তে চুক্তিটি বৈধ নাকি অবৈধ তা বলার কোনো সুযোগ নেই।”
উক্ত মন্তব্যের ভিত্তিতে, আবেদনটি খারিজ করা হয়। তবে, হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের ১০৩(২)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাজী মোখলেসুর রহমানকে একটি সার্টিফিকেট* প্রদান করেন, যেখানে উল্লেখ করা হয়, “এই মামলায় সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা জড়িত।” পরবর্তীতে, কাজী মোখলেসুর রহমান হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে (সিভিল আপিল নং ২৩/১৯৭৪) আপিল দায়ের করেন।
*[উল্লেখ্য যে, হাইকোর্ট বিভাগ যদি কোন মামলায় এই মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করেন যে, উক্ত মামলায় সংবিধান ব্যাখ্যার বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত আছে, সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে অধিকার বলে সরাসরি আপিল করা যাবে। অপরদিকে, হাইকোর্ট বিভাগ যদি কোন প্রকার সার্টিফিকেট প্রদান না করেন, সেক্ষেত্রে আপিল করার জন্য আপিল বিভাগের অনুমতি প্রয়োজন হবে।]
ইস্যু :
১. হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেট কি সঠিক ছিল?
২. কাজী মোখলেসুর রহমানের কি “লোকাস স্ট্যান্ডি” ছিল?
৩. মুজিব ইন্দিরা চুক্তিটি কি বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার এখতিয়ারাধীন ছিল?
৪. কাজী মোখলেসুর রহমানের করা রিট আবেদনটি কি “প্রিম্যাচিউর” (যথা সময়ের পূর্বে করা আবেদন) ছিল?
যুক্তিতর্ক :
বিবাদীপক্ষ থেকে সর্বপ্রথম আপত্তি উত্থাপন করা হয় যে, হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত সনদ একটি “ত্রুটিপূর্ণ সার্টিফিকেট।”
বিবাদীপক্ষ যুক্তি উত্থাপন করেন যে, যদি হাইকোর্ট বিভাগ ১০৩(২)(ক) অনুচ্ছেদের অধীনে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেন এই মর্মে যে, এ মামলায় সংবিধানের অনুচ্ছেদ সমূহের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা জড়িত। তখন হাইকোর্ট বিভাগকে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে যে, সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ সমূহের ব্যাখ্যা এখানে জড়িত এবং তা করতে ব্যর্থ হলে এই সনদটি একটি “ত্রুটিপূর্ণ সার্টিফিকেট” হিসেবে গণ্য হবে। বিবাদীপক্ষ তার বক্তব্যের সমর্থনে কিছু ভারতীয় ও পাকিস্তানি মামলা উপস্থাপন করেন।
১. বেনারসি প্রসাদ বনাম কাশী কৃষ্ণ নারায়ণ (LR. 28 Indian Appeals 11)
২. রাধা কৃষান দাস বনাম রায় কৃষান চাঁদ (LR. 28 Indian Appeals 182)
৩. রাধা কৃষ্ণ আইয়ার বনাম স্বামীনাথ আইয়ার (LR. 48 Indian Appeals 31)
৪. মেম্বার বোর্ড অফ রেভিনিউ বনাম আখতার খান (P.L.D 1969 S C 270)
৫. শশী ভূষণ বনাম আসগর আলী [20 DLR (SC) 217]
এ মামলা গুলোর মূল বিষয় হচ্ছে, সংবিধান সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাখ্যা যদি কোনো মামলার সাথে জড়িত থাকে, আদালত শুধু সার্টিফিকেট প্রদান করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করবেন না। বরং আদালত সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করবেন যে, সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদসমূহের ব্যাখ্যা উক্ত মামলার সাথে জড়িত। এই মামলাগুলো উল্লেখ করে, বিবাদীপক্ষ দাবি করেন, যেহেতু এই সার্টিফিকেটটি ত্রুটিপূর্ণ, তাই আপিল আবেদনটি আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তাই আপিল আবেদনটি খারিজ করা উচিত।
আপিল বিভাগ বিবাদীপক্ষের দাবির সাথে একমত পোষণ করে বললেন,
“হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটটি একটি ত্রুটিপূর্ণ সার্টিফিকেট। কারণ সংবিধানের কোন কোন অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা এখানে জড়িত তা হাইকোর্ট বিভাগ উল্লেখ করেন নি।”
তবে আপিল বিভাগ এই মন্তব্যটি করেন যে, তা সত্ত্বেও মামলাটি আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না কারণ এই মামলায় সংবিধান সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত।
বিবাদীপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় দাবিটি ছিল, রিট দায়েরের এখতিয়ার সম্পর্কে যা “লোকাস স্ট্যান্ডি” নামে পরিচিত। কাজী মোখলেসুর রহমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(আ) অনুচ্ছেদের অধীনে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন যাতে বলা হয়েছে-
“(ক) যে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে-
(আ) প্রজাতন্ত্র বা কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিষয়াবলির সহিত সংশ্লিষ্ট যে কোন দায়িত্ব পালনে রত ব্যক্তির কৃত কোন কার্য বা গৃহীত কোন কার্যধারা আইনসংগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে করা হইয়াছে বা গৃহীত হইয়াছে ও তাঁহার কোন আইনগত কার্যকরতা নাই বলিয়া ঘোষণা করিয়া
উক্ত বিভাগ আদেশদান করিতে পারিবেন”
বিবাদীপক্ষ বলেন, কাজী মোখলেসুর রহমান মুজিব – ইন্দিরা চুক্তির অন্তর্ভুক্ত কোনো এলাকার অধিবাসী নন। তাই তাঁকে “সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি” হিসেবে অভিহিত করার কোনো সুযোগ নেই। বিবাদীপক্ষ আরো বলেন, “সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(আ) অনুযায়ী শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত কতিপয় আদেশ প্রদান করতে পারেন। যেহেতু কাজী মোখলেসুর রহমান “সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি” নন, সেহেতু তার আপিল দায়েরের কোনো এখতিয়ার নেই।” তাই বিবাদীপক্ষ যুক্তি উত্থাপন করেন যে আপিলটি খারিজ করে দেওয়া উচিত।
অপরদিকে কাজী মোখলেসুর রহমান বলেন, “যেহেতু সংবিধানের ১০২(২) এ প্রদত্ত এখতিয়ারটি আদালতের বিবেচনামূলক এখতিয়ার, সেহেতু অনুচ্ছেদটিতে বর্ণিত “যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি” এই শব্দগুচ্ছটি উদারভাবে গ্রহণ করে আদালতকে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা উচিত।”
তিনি আরো বলেন যে তার আপিলটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কারণ মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটির ফলে তাঁর বাংলাদেশে সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপনের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়েছে যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ “৩৬” এ উল্লিখিত রয়েছে। এছাড়াও তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তার এই আপিল আবেদনটির সাথে সংবিধান সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও জড়িত।
আপিল বিভাগ এ বিষয়ে বলেন,
” ‘লোকাস স্ট্যান্ডি’-র বিষয়টি আদালতের সম্পূর্ণ বিবেচনামূলক একটি এখতিয়ার যা প্রতিটি মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আদালত নির্ধারণ করে থাকেন” আপিল বিভাগ আরো বলেন যে, “যদিও আপিলকারী মুজিব – ইন্দিরা চুক্তির অন্তর্গত ‘১২ নং দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন’ বা সংলগ্ন কোনো ছিটমহলের অধিবাসী নন, তবে মাত্র দুইটি কারণে কাজী মোখলেসুর রহমানের লোকাস স্ট্যান্ডি আছে বলে আদালত মনে করেন –
১) এই চুক্তির ফলে কাজী মোখলেসুর রহমানের বাংলাদেশে সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপনের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের একটি আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে এবং এই প্রকারের অধিকারগুলো একজন ব্যক্তির স্থানীয় অধিকার নয়। বরং এই অধিকারগুলো সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি থেকে সাগরের মহীসোপান পর্যন্ত বিস্তৃত ও প্রসারিত।
২) এই চুক্তির সাথে সংবিধানের অনুচ্ছেদসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত।”
বিবাদী পক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত তৃতীয় যুক্তিটি ছিল, চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় কার্য এর অন্তর্গত। তাই এই চুক্তিটি “বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার” এখতিয়ারাধীন নয়।
আপিল বিভাগ বলেন যে,
“শান্তিপূর্ণ সময়ে কোনো নাগরিককে তার অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই ‘রাষ্ট্রীয় কার্য’ এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না এবং আদালতের এখতিয়ার রয়েছে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার। রাষ্ট্রীয় কার্য এর অজুহাত আদালতের এই হস্তক্ষেপের ক্ষমতাটিকে দমন করতে পারে না, যখন নাগরিক এর অধিকার এবং স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়।”
বিবাদী পক্ষ থেকে চতুর্থ ও শেষ আপত্তি উত্থাপন করা হয় এই মর্মে যে, এই চুক্তিটি এখনও কার্যকর হয়নি। তাই এই আপিল আবেদনটি প্রিম্যাচিউর (যথা সময়ের পূর্বে করা আবেদন) এই মর্মে বিবেচনা করা হোক এবং চুক্তিটি বৈধ বা অবৈধ তা বলার কোনো সুযোগ নেই।
আপিল বিভাগ বিবাদী পক্ষের দাবির সাথে একমত পোষণ করে মন্তব্য করেন যে,
“যেহেতু চুক্তি সংক্রান্ত দলিল হস্তান্তরের পর চুক্তিটি কার্যকর হবে, তাই এই চুক্তিটিকে ‘সম্পাদিত চুক্তি’ হিসেবে গণ্য করা যাবে না বরং এই চুক্তি টি একটি ‘নিষ্ক্রিয় প্রকৃতির চুক্তি’ এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(আ) অনুযায়ী ‘চুক্তিটি আইনি কর্তৃপক্ষ ব্যতীত করা হয়েছে এবং চুক্তিটির কোনো আইনগত বৈধতা নেই’ এই মর্মে আদালতের চুক্তিটিকে বাতিল করার কোনো সুযোগ নেই।”
সিদ্ধান্ত :
আপিল বিভাগ বিবাদীপক্ষের চতুর্থ ও শেষ আপত্তির ভিত্তিতে আপিলটি খারিজ করে দেন। তবে আপিল বিভাগ সংবিধানের ৫৫(২), ১৪২, এবং ১৪৩(২) অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে বলেন,
“যদিও সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চুক্তি করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত, কিন্তু এই চুক্তিতে রাষ্ট্রের সীমানার বিষয়টি জড়িত। তাই, এই চুক্তি কার্যকর করতে সংবিধানের ১৪৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এটি অনুমোদন করতে হবে।”
সংবিধানের ১৪৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী:
“(২) সংসদ সময়ে সময়ে আইনের দ্বারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমা ও মহীসোপানের সীমা-নির্ধারণের বিধান করিতে পারিবেন।”
আপিল বিভাগ আরও উল্লেখ করেন,
“এই চুক্তিতে ভূখণ্ড থেকে কর্তৃত্ব প্রত্যাহারের বিষয়টি জড়িত। তাই, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটি কার্যকর করতে সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে।”
পরবর্তী পর্যালোচনা :
এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ নভেম্বর, ১৯৭৪ সালে সংবিধানের ৩য় সংশোধনী করা হয়। ৩য় সংশোধনীর মাধ্যমে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদকে সংশোধন করা হয়।
৩য় সংশোধনীর পূর্বে সংবিধান ২নং অনুচ্ছেদ ছিল এরূপ:
“২। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে-
(ক) ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখের স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যাহতি পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব-পাকিস্তান গঠিত ছিল।”
৩য় সংশোধনী পর, অনুচ্ছেদ ২(ক) নিম্নরূপ:
“২৷ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে
(ক) ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা-ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল [এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা, কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভূত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা তদবহির্ভূত ; এবং]”
এই মামলার মাধ্যমে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো ‘জনস্বার্থ মামলা’ (Public Interest Litigation বা PIL) এর ধারণার সূচনা হয়। পরে এটি স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ড. মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য (১৯৯৭) মামলায়।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর, বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৭৪ সালের ৩য় সংশোধনী এবং ভারতের সংবিধানের ২০১৫ সালের ১০০তম সংশোধনীর মাধ্যমে বহু বছর পরে ৫১টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের এবং ১১১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- ভারতীয় সংবিধান
- অনুচ্ছেদ : ১(৩)(গ), ৩, ১৪৩(১), ৩৬৮
- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
- অনুচ্ছেদ : ২(ক), ৩৬, ৫৫(২), ১০২(২)(ক)(আ), ১০৩(২)(ক), ১৪২, ১৪৩(২)
অনুবাদক :
১. ফাহিম আহমেদ
২. মো. আতিকুর রহমান
৩. রুদ্র জয়া
৪. রোজিনা আকতার নিশু
৫. রাইয়ান তালুকদার
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ