আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য
সাইটেশন : 1989 BLD (SPL) 1
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
আবেদনকারী : আনোয়ার হোসেন চৌধুরী
বিবাদী : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য
ঐতিহাসিক পটভূমি :
বাংলাদেশে দ্বিতীয় সামরিক শাসনামলে (১৯৮২–৮৬), ১৯৮২ সালে একাধিক সামরিক আইনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে সাতটি স্থায়ী বেঞ্চে বিভক্ত করা হয়। এই সাতটি বেঞ্চের মধ্যে ছয়টি রাজধানীর বাইরে স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০০ সংশোধন করে সংবিধান (অষ্টম সংশোধনী) আইন, ১৯৮৮ দ্বারা এই বিভাজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উক্ত সংশোধনীটি রাষ্ট্রপতিকে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব বেঞ্চের আঞ্চলিক এখতিয়ার নির্ধারণের ক্ষমতা প্রদান করে। এই আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ -কে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
এছাড়াও নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলো সংশোধন করা হয়:
অনুচ্ছেদ ৫ – ‘Bengali’ শব্দের পরিবর্তে ‘Bangla’ এবং ‘Dacca’-এর পরিবর্তে ‘Dhaka’ করা হয়।
অনুচ্ছেদ ৩০ – রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের বিদেশি রাষ্ট্র হতে উপাধি, সম্মাননা, পুরস্কার বা পদক গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়।
অনুচ্ছেদ ১০০-এর সংশোধন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, কারণ, এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪-এ বর্ণিত সুপ্রিম কোর্টের ‘একক চরিত্র’ (unitary character) লঙ্ঘন করে। উক্ত ঘটনার ভিত্তিতে, আনোয়ার হোসেন চৌধুরী একটি রিট আবেদন দায়ের করেন এবং অষ্টম সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন।
ঘটনা :
আনোয়ার হোসেন চৌধুরী একটি স্থগিতাদেশের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন যার জন্য একটি প্রতি-হলফনামা দাখিল করতে হতো। তবে, ঢাকার হলফনামা কমিশনার তার হলফনামা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে জানানো হয় যে, অষ্টম সংশোধনীর অধীনে, তার রিট আবেদন স্থানান্তরিত হয়ে সিলেটে নবগঠিত স্থায়ী বেঞ্চে চলে গেছে, কারণ মামলাটি ঐ অঞ্চল সংশ্লিষ্ট ছিল। এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে, আপিলকারী সংশোধনী আইনের সাংবিধানিকতা চ্যালেঞ্জ করেন। হাইকোর্ট বিভাগ ৩১ অক্টোবর ১৯৮৮ তারিখে রায় প্রদান করে এবং সংক্ষিপ্তভাবে রিট আবেদন খারিজ করে দেন। তবে, সংবিধানের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে, আপিল বিভাগ আপিল করার অনুমতি প্রদান করেন এবং মামলাটি দেওয়ানী আপিল নং ৪২/১৯৮৮ হিসেবে নিবন্ধিত হয়।
ইস্যু :
১. সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী, অসাংবিধানিক ছিলো কি না?
যুক্তিতর্ক :
আপিলকারীর পক্ষে ড. কামাল হোসেন ও সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ যুক্তি দেন যে, অষ্টম সংশোধনী সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪-এ নির্ধারিত সুপ্রিম কোর্টের একক কাঠামো লঙ্ঘন করেছে এবং হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গ এখতিয়ার (plenary jurisdiction) বিনষ্ট করেছে। সংবিধানের নকশা অনুযায়ী, হাইকোর্ট বিভাগ সমগ্র রাষ্ট্রের উপর বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। তবে, সাতটি পৃথক হাইকোর্ট বেঞ্চ গঠনের মাধ্যমে সংশোধনীটি বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব দুর্বল করেছে, বিচারব্যবস্থাকে বিভাজিত করেছে এবং সাংবিধানিক নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। তারা যুক্তি দেন যে, অনুচ্ছেদ ১৪২, সংবিধানের মূল কাঠামোকে বিনষ্ট করার মতো পরিবর্তন অনুমোদন করে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও অধস্তন আদালতগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ, সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা অষ্টম সংশোধনী দ্বারা ব্যাহত হয়েছে। এই সংশোধনী কার্যত অনুচ্ছেদ ৪৪, ১০১, ১০২, ১০৭, ১০৯, ১১০, ও ১১১ তে প্রভাব ফেলে এবং সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে সীমিত করে, যা সংসদীয় ব্যবস্থার মতো পৃথক “ক্ষুদ্র সংসদ” সৃষ্টির সমতুল্য। এটি একক ও ঐক্যবদ্ধ শাসনব্যবস্থার পরিপন্থি। তারা আরও যুক্তি দেন যে, অষ্টম সংশোধনী, অনুচ্ছেদ ৭ -কে লঙ্ঘন করেছে, উক্ত অনুচ্ছেদ মূলত ক্ষমতার বিভাজন (separation of powers) ও সীমিত কর্তৃত্ব নীতিকে সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের গঠন ভারত বা পাকিস্তানের মতো নয় বরং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টকে পূর্ণাঙ্গ এখতিয়ারের (plenary jurisdiction) ভিত্তিতে গঠন করা হয়েছে, তাই আঞ্চলিক হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রবর্তন করা সংবিধানের মূল কাঠামো বিনষ্টের শামিল। এছাড়াও, অনুচ্ছেদ ১০০(৫) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বেঞ্চগুলোর আঞ্চলিক এখতিয়ার নির্ধারণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যা অবৈধ ক্ষমতা প্রদান বলে বিবেচিত হয়। যেহেতু সংশোধনী নিজেই অসাংবিধানিক, তাই এর অধীনে প্রণীত বিধিগুলোও অকার্যকর ও অবৈধ। সার্বিকভাবে, তারা দাবি করেন যে, অষ্টম সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধানের মূল কাঠামোর ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং এটি বাতিল করা উচিত।
বিবাদীর পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দেন যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২-এর অধীনে সংসদকে ব্যাপক সংশোধনী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা অনুচ্ছেদ ৭ দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের জন্য স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা, হাইকোর্টের সংহতি বা এখতিয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি; বরং এটি কার্যকারিতা ও সুবিধার জন্য একটি কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস মাত্র। তিনি আরও যুক্তি দেন যে, এই পরিবর্তনের ফলে বিচারপতিগণ বিভিন্ন স্থানে বসতে পারলেও তাদের ক্ষমতা একই থেকে গেছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা ক্ষমতার বিভাজন লঙ্ঘন করে না। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, অনুচ্ছেদ ১০০(৫) এর অধীনে প্রণীত বিধিগুলো সাংবিধানিক এবং বৈধ, কারণ এগুলো হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতা বা এখতিয়ারে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনে না। তিনি আরও বলেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গ এখতিয়ার বহাল রয়েছে, কারণ হাইকোর্ট বিভাগ এখনও তার আঞ্চলিক সীমার বাইরে রিট আদেশ জারি করতে পারে। সর্বশেষে, তিনি যুক্তি দেন যে অষ্টম সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি এবং এটি আগের সংশোধনীগুলোর ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে।
সিদ্ধান্ত :
আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আপিলকারীর পক্ষে রায় প্রদান করেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন যে, সংসদ সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা রাখে, তবে এই ক্ষমতা সীমিত। যদিও সংসদের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা স্বীকৃত, তবে এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস বা পরিবর্তন করতে পারে না। সংশোধনী ক্ষমতা একটি অনুমোদিত ক্ষমতা, যা সংসদকে জনগণের দ্বারা অর্পিত হয়েছে, এবং যেকোনো পরিবর্তন অবশ্যই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আদালত এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে বলেন যে, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে আনিত পরিবর্তনগুলো সংবিধানকে উন্নত বা শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত, এর মৌলিক চরিত্র পরিবর্তনের জন্য নয়। সুতরাং, আদালত অষ্টম সংবিধান সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন।
আদালত এই মামলার রায়ে “বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন” প্রয়োগ করেন।
সংশ্লিষ্ট আইনি নীতি :
বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন : সংবিধানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ শুধু রাষ্ট্রের জনগণের জন্য সংরক্ষিত, যেমন সংবিধানের সর্বোচ্চতা, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিক সরকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, একক রাষ্ট্র কাঠামো, ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং মৌলিক অধিকার। সংবিধানের এই কাঠামোগত স্তম্ভগুলি সংশোধনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। সংশোধিত অনুচ্ছেদ-১০০ আল্ট্রা ভায়ার্স (অসাংবিধানিক), কারণ এটি স্থায়ী বেঞ্চের নামে হাইকোর্ট বিভাগের প্রতিদ্বন্দ্বী আদালত সৃষ্টি করে বিচার বিভাগকে ক্ষমতাকে দুর্বল করেছে এবং তাদের (নতুন সৃষ্ট বিভাগ) পূর্ণ এখতিয়ার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করেছে।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
- অনুচ্ছেদ : ৫, ৭, ৩০, ৯৪, ১০০, ১০১, ১০২, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১১১, ১৪২
অনুবাদক :
১. মো. আল আমিন
[সতর্কতা : উক্ত মামলার বাংলা সংস্করণটি মূল ইংরেজি হতে অনূদিত। অর্থগত সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কোনো প্রকার অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হলে, মূল ইংরেজি সংস্করণ প্রাধান্য পাবে।]
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ