রাষ্ট্র এবং অন্যান্য বনাম ডসো এবং অন্যান্য
সাইটেশন : 11 DLR (1959) 1
জুরিসডিকশন : পাকিস্তান
আপিলকারী : রাষ্ট্র এবং অন্যান্য
বিবাদী : ডসো এবং অন্যান্য
ঐতিহাসিক পটভূমি :
পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান (১৯৫৬) -এর ভিত্তিতে গভর্নর জেনারেলের পদকে রাষ্ট্রপতির পদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয় এবং সংসদ কর্তৃক ইস্কান্দার মির্জাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে, রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা সেনাবাহিনীর সমর্থনে ১৯৫৬ সালের সংবিধান স্থগিত করেন। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তিনি ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন (মার্শাল ল) জারি করেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খানকে মার্শাল ল’ প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৫৮ সালের ১০ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক “ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার, ১৯৫৮” জারি করা হয়।
ঘটনা :
বেলুচিস্তানের লোরালাই জেলায় ডসো নামের একজন ব্যক্তির দ্বারা একটি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। তাকে গ্রেফতার করে লয়া জিরগা নামে পরিচিত স্থানীয় উপজাতীয় বিচার পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। উক্ত পরিষদ তাকে ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস রেগুলেশন (এফসিআর), ১৯০১ এর ১১ ধারার অধীনে অভিযুক্ত করেন। জিরগা তাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করেন। লয়া জিরগার উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, ডসোর পরিবার লাহোর হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। তারা দণ্ডাদেশের প্রতি আপত্তি জানিয়ে যুক্তি দেন যে, এফসিআর-এর ধারা ১১ ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ এবং ‘আইনের দ্বারা সমান সুরক্ষা প্রাপ্তি’ নীতির পরিপন্থী এবং ১৯৫৬-এর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ ও ৭-এ বর্ণিত আইনি সহায়তা প্রাপ্তির অধিকারের পরিপন্থী।
ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস রেগুলেশন (এফসিআর)- ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ ও ৭-এর সাথে সাংঘর্ষিক, বলে আদালত জানান। আদালত ডসোর পক্ষে রায় প্রদান করেন এবং এফসিআর, ১৯০১ -এর অধীনে বিচার পরিষদের (লয়া জিরগা-র) কার্যক্রম ও ঘোষিত রায় বাতিল বলে ঘোষণা করেন। ফলশ্রুতিতে, এফসিআর-এর ভিত্তিতে প্রদত্ত সকল সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো, প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
পরবর্তীতে, পাকিস্তান সরকার লাহোর হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে। একটি অস্থির রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, পূর্বনির্ধারিত তারিখ, ১৩ অক্টোবর ১৯৫৬-এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
ইস্যু :
১. ১৯০১ সালের ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস রেগুলেশন (এফসিআর) কি ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ ও ৭-এর অধীনে অসাংবিধানিক ছিল?
২. ১৯৫৮ সালের ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার, ১৯৫৮ কি পূর্ববর্তী সংবিধানের বিধানগুলো, বিশেষত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণকারী ধারাগুলোকে বাতিল করে একটি নতুন আইনি কাঠামো তৈরি করেছিল?
সিদ্ধান্ত :
সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে লাহোর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।
আইনি প্রশ্নগুলোর উত্তরে সুপ্রিম কোর্ট রায় প্রদান করেন যে, ১৯৫৮ সালের সামরিক আইন (মার্শাল ল’) জারি ছিল একটি শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের সমতুল্য। সাধারণ জনগণ এটির প্রতিহত বা প্রতিবাদ করেনি, তাই এই বিপ্লব বা মার্শাল ল’ জারি আইনগতভাবে বৈধ—যতদিন তা জনগণের স্বার্থ পূরণ করে। প্রধান বিচারপতি মুনির এ বিষয়ে যুগান্তকারী যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “যদি সংবিধান ভাঙার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাহলে যারা এটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে বা সংগঠিত করে, তাদেরকে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত। কিন্তু যদি বিপ্লবটি এই অর্থে সফল হয় যে, দেশের অধিবাসীদের নতুন শাসন ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে পরিবর্তনের ফলে ক্ষমতায় আসা ব্যক্তিবর্গ সফলভাবে বাধ্য করতে পারেন, তখন সেই বিপ্লব আপনা আপনিই একটি আইন-প্রনয়নকারি বাস্তবতায় রূপ নেয়, কারণ পরবর্তীতে এটির নিজের বৈধতা বাতিলকৃত সংবিধানের দ্বারা নয়, বরং এর নিজস্ব সাফল্যের ভিত্তিতেই বিচার করা হবে।”
সুপ্রিম কোর্ট রায় প্রদানের ক্ষেত্রে হ্যান্স কেলসেনের ‘আইনি ইতিবাচকতার তত্ত্ব’ (Leagl Theory of Positivism) উল্লেখ করেন। যেখানে হ্যান্স কেলসেন বলেছেন, “যদি পুরাতন সংবিধানের অধীনে প্রণীত আইনগুলো নতুন সংবিধানের অধীনে বৈধ থাকে, তবে এটি কেবল তখনই সম্ভব যখন নতুন সংবিধান স্পষ্টভাবে বা অন্তরালে তাদের বৈধতা প্রদান করে।“ ইতিবাচকতার তত্ত্ব অনুসারে, বিল্পব বলতে বুঝায়, পূর্বানুমেয় নয় এরূপ পদ্ধতিতে পুরানো ব্যবস্থা বদলে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এর ভিত্তিতে, আদালত সামরিক আইন জারিকে বৈধতা দান করে রায় প্রদান করেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে লাহোর কোর্ট ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ভিত্তিতে রায় দিয়েছিলেন। উক্ত সংবিধান অনুযায়ী, এফসিআর, ১৯০১-এর সিদ্ধান্ত অসাংবিধান ছিল। তবে, লাহোর কোর্টের এই দাবি বাতিল হয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি মুনির যুক্তি দেন যে, ৭ অক্টোবরের ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ২৩ মার্চ ১৯৫৬-এর সংবিধান বাতিল করেন এবং তিন দিন পর ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার জারি করেন, যা কার্যকরভাবে পূর্ববর্তী সংবিধান ব্যতীত ঘোষণার আগে বলবৎ থাকা সকল আইনকে বৈধতা দেয়। ফলে এফসিআর আদেশ এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টসহ সকল আদালতের এখতিয়ারও পুনর্বহাল থাকে।
বিচারপতি এ.আর. কর্নেলিয়াস যুক্তি দেন যে, ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস রেগুলেশন (এফসিআর) -এর জন্য এখন আর ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সুরক্ষা মেনে চলার প্রয়োজনীতা নেই, যেহেতু এর বৈধতা এখন ১৯৫৮ সালের ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। যেহেতু ১৯৫৬ সালের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক আইন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা এই আদেশ দ্বারা রহিত করা হয়েছে, তাই এফসিআর-এর বৈধতা এখন কেবল ১৯৫৮-পরবর্তী নতুন আইনি কাঠামোর অধীনেই মূল্যায়ন করা হবে।
বিচারপতি আমিরুদ্দিন আহমদ এর মতে, ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল হওয়া সত্ত্বেও, ১৯৫৮ সালের ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার -এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে পুরানো সংবিধানের যতটা সম্ভব কাছাকাছি নিয়মে পরিচালনা করা, তবে তা রাষ্ট্রপতির আদেশ ও সামরিক আইনের বিধিমালার অধীন থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট তখনও রিট জারি করতে পারতেন, তবে প্রধান বা উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক দ্বারা জারি করা আদেশের বিরুদ্ধে নয়।
সর্বশেষ, আদালত উল্লেখ করেন যে, ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডারটি ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস রেগুলেশন (এফসিআর) উপর ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিলের দ্বারা আরোপিত সীমাবদ্ধতা দূর করেছে। অতএব, এফসিআর-এর অধীনে পূর্বে প্রদত্ত দণ্ড ও সাজা বহাল থাকবে। জিরগার সামনে বিচারাধীন মামলাগুলো এফসিআর-এর বিধান অনুযায়ী চলতে থাকবে। এই মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ভিত্তিতে, হাইকোর্টের প্রদত্ত নির্দেশনা ও রিট আদেশ বাতিল করা হয়, কারণ তা ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নতুন আইনি কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস রেগুলেশন (এফসিআর), ১৯০১ (বৃটিশ ভারত এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান)
- ধারা : ১১
- ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৫৬
- অনুচ্ছেদ : ৫, ৭
- ল’স (কন্টিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার, ১৯৫৮ (পাকিস্তান)
অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান
[সতর্কতা : উক্ত মামলার বাংলা সংস্করণটি মূল ইংরেজি হতে অনূদিত। অর্থগত সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কোনো প্রকার অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হলে, মূল ইংরেজি সংস্করণ প্রাধান্য পাবে।]
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ