বাংলাদেশ সয়া-প্রোটিন প্রজেক্ট লিমিটেড বনাম সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
সাইটেশন : 6BLC 681 (2001)
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
আবেদনকারী : বাংলাদেশ সয়া-প্রোটিন প্রোজেক্ট লিমিটেড
বিবাদী : সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
ঘটনা :
বিবাদের সূচনা হয় যখন সরকার আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরি সয়া-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য দ্বারা পরিচালিত স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেয়। সয়া খাদ্য প্রস্তুতকরণের প্রযুক্তি ১৯৭৬ সালে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়, এবং ১৯৮৯ সাল নাগাদ সরকার স্কুলশিক্ষার্থীদের সয়া-ভিত্তিক খাদ্য প্রদান শুরু করে। এটির ইতিবাচক প্রভাবগুলো পরবর্তীতে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ১৯৯২ সালে কর্মসূচিটি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হলেও ১৯৯৫ সালে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে সরবরাহ ও পর্যবেক্ষণ জনিত চুক্তির মাধ্যমে সরকারি নীতি হিসাবে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় চালু করা হয়। বেশ সফল হওয়া সত্ত্বেও ২০০০ সালের জুলাই মাসে হঠাৎ প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়। এর ফলে আবেদনকারীগণ কর্মহীন হয়ে পড়েন। সরকারের নীতির ভিত্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ ও ন্যায়সংগত প্রত্যাশা দাবি করে আবেদনকারীগণ প্রোগ্রামটি পুনরায় চালুর জন্য সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি রিট আবেদন করেন। তবে সরকার এর বিরোধিতা করে বলে যে কর্মসূচিটি ছিল শুধু চুক্তিভিত্তিক, এবং সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় দরুন বিষয়টি রিটের এখতিয়ারে পড়ে না।
ইস্যু :
১. রাষ্ট্রীয় নীতি এবং চুক্তির মাধ্যমে তৈরি হওয়া আবেদনকারীর বৈধ প্রত্যাশা কি সরকার কর্তৃক স্কুল ফিডিং কর্মসূচি বন্ধ করার মাধ্যমে লঙ্ঘিত হয়েছে?
২. ইস্যুটি কি রিটের এখতিয়ারের বাইরে কেবল একটি চুক্তিভিত্তিক সমস্যা ছিল?
যুক্তিতর্ক :
আবেদনকারী পক্ষের যুক্তি :
আবেদনকারী যুক্তি উত্থাপন করেন যে, প্রকল্পটিতে তাদের বিপুল অর্থের বিনিয়োগ, প্রকলপের দৃশ্যমান সাফল্য এবং জাতীয় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, সরকার কর্তৃক হঠাৎ করে ফিডিং প্রোগ্রামটি বন্ধ করা ছিলো অন্যায্য এবং বৈধ প্রত্যাশার পরিপন্থি।
আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান সরকার পরিচালিত স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামকে সহায়তা করতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে এবং বহু শ্রমিক নিয়োগ দেয়। কিন্তু মন্ত্রীগণ প্রোগ্রামটি বন্ধ করে দেন। যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি বিপাকে পড়ে। এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগের সত্ত্বেও সরকার কোনো সাড়া দেয়নি। আবেদনকারী দাবি করেন যে, প্রোগ্রামটি পুনরায় চালু করার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয় একটি সারসংক্ষেপে, যা ১৯৯৭ সালের ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর একটি নতুন চুক্তির মাধ্যমে প্রোগ্রামটি পুনরায় চালু করা হয়। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর অনুরোধে সিরাজগঞ্জ জেলার সদর থানার ও কাজিপাড়া থানার আওতায় স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটি মূল্যায়ন করা হয়। উক্ত মূল্যায়নেও প্রোগ্রামটি পুনরায় চালুর বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় প্রোগ্রামটি পুনরায় চালু করার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন দাখিল করে।
আবেদনকারী পক্ষ আরও যুক্তি দেন যে, অপুষ্ট শিশুদের উপকারে উচ্চমানের সয়াপণ্য উৎপাদনে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিষ্ঠার কারণেই প্রোগ্রামটি সফল হয় এবং ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। যেহেতু প্রোগ্রামটি সফল ছিল, তাই আবেদনকারীর স্বাভাবিকভাবেই বৈধ প্রত্যাশা ছিল যে অপুষ্ট শিশুদের স্বার্থে এই প্রোগ্রামটি যুক্তিসংগত সময় পর্যন্ত চালু থাকবে। আবেদনকারী বলেন যে মন্ত্রণালয় অন্যায়, অযৌক্তিক এবং অমানবিক আচরণ করেছে, যার ফলে শুধু আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ অপুষ্ট শিশুও প্রোগ্রামটির সুফল পাওয়ার বৈধ প্রত্যাশা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বিবাদী পক্ষের যুক্তি:
বিবাদীপক্ষ রিট আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রাথমিক আপত্তি তোলে। বিবাদীপক্ষ যুক্তি দেখায় যে আবেদনকারীর অধিকার শুধু আবেদনকারী কোম্পানি ও সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে চুক্তিগত সম্পর্ক থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। যেহেতু চুক্তির নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার মাধ্যমে চুক্তি সমাপ্ত হয়েছে, তাই সাংবিধানিক রিট এখতিয়ারের মাধ্যমে কোনো অধিকার আর বলবৎ করা যায় না। ফলে, সরকারের আইন অনুযায়ী স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতায় ছিল না। বিবাদী আরও বলেন যে, চুক্তিভিত্তিক বিষয়সমূহ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নয়, বরং দেওয়ানি প্রতিকারপন্থার মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। পরিশেষে, রিট আবেদনটি গ্রহণযোগ্য নয়, এই ভিত্তিতে বিবাদী পক্ষ রিট আবেদনটি খারিজ করার আবেদন করেন।
সিদ্ধান্ত :
বৈধ প্রত্যাশা নীতি এবং ওয়েডনেসবারি অযৌক্তিকতা পরীক্ষার প্রয়োগের মাধ্যমে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, মন্ত্রণালয় প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো বিবেচনা করেনি। বরং, তাদের নিজেদের নীতি উপেক্ষা করে এমনভাবে কাজ করেছে, যা কোনো যুক্তিসংগত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। অতএব, এই প্রোগ্রামটি বন্ধ করা ছিল অযৌক্তিক এবং স্বেচ্ছাচারী। ফলস্বরূপ শুধু আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সেই লক্ষ লক্ষ অসহায় ও অপুষ্ট শিশুদের প্রতি, যাদের এই প্রোগ্রামটি সেবা দিতে চেয়েছিল তাদের বৈধ প্রত্যাশারও চরম লঙ্ঘন হয়।
ফলশ্রুতিতে, আদালত চূড়ান্তভাবে রুল জারি করেন এবং সরকারকে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম সম্পর্কিত নিজস্ব নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। আদালত স্পষ্ট করে জানান যে, সেবাগ্রহীতার সংখ্যা ও পরিধি নির্ধারণে সরকারের নিজস্ব বিবেচনা থাকবে, তবে প্রোগ্রামটি পুনরায় চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, এবং সর্বোত্তমভাবে দুই মাসের মধ্যে তা করা উচিত।
সংশ্লিষ্ট আইনি নীতি :
বৈধ প্রত্যাশার নীতি: বৈধ প্রত্যাশার নীতি প্রশাসনিক আইনের একটি নীতি, যা ব্যক্তি বিশেষকে হঠাৎ বা অন্যায়ভাবে সরকারি নীতি বা সিদ্ধান্তের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, বিশেষ করে যখন তারা পূর্বের কর্মকাণ্ড, প্রতিশ্রুতি বা সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠিত চর্চার উপর ভিত্তি করে কোনো নির্দিষ্ট আচরণের প্রত্যাশা করে থাকেন। তবে কিছুক্ষেত্রে বৈধ প্রত্যাশা কেবল বৈধ জনস্বার্থের কারণে অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে বৈধ কারণ বা জনস্বার্থের ভিত্তি দেখিয়ে বৈধ প্রত্যাশা নাকচ করার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ওয়েডনেসবারি নীতি বা অযৌক্তিকতার পরীক্ষা: ওয়েডনেসবারি নীতি বা অযৌক্তিকতার পরীক্ষা হলো একটি আইনি মানদণ্ড, যার মাধ্যমে আদালত নির্ধারণ করে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এতটাই অযৌক্তিক কি না, যা কোনো যুক্তিসম্পন্ন কর্তৃপক্ষ কখনও গ্রহণ করত না।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
- অনুচ্ছেদ: ১০২
অনুবাদক :
১ . রাইয়ান তালুকদার
২. মো. আতিকুর রহমান
[সতর্কতা : উক্ত মামলার বাংলা সংস্করণটি মূল ইংরেজি হতে অনূদিত। অর্থগত সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কোনো প্রকার অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হলে, মূল ইংরেজি সংস্করণ প্রাধান্য পাবে।]
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ