এ.কে.এম. ফজলুল হক বনাম রাষ্ট্র (১৯৭৪)

AKM Fazlul H v State Case FP BN

এ.কে.এম. ফজলুল হক এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র

রেফারেন্স : 26 DLR (AD) (1974) 11

জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ

বাদী : এ. কে. এম. ফজলুল হক এবং অন্যান্য (বিবাদী, নিম্ন আদালতে)
বিবাদী : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (বাদী, নিম্ন আদালতে)

পটভূমি :

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়েছিল, যেখানে প্রাথমিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। উক্ত ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, সর্বোচ্চ নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা এবং প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী নির্বাচন করার ক্ষমতা এককভাবে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত ছিল। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” জারি করেন। যার ৫ থেকে ৮ নং ধারা মোতাবেক, সরকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি শাসিত থেকে সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হয়। এই আদেশে আরও বলা হয় যে, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নিকট ন্যস্ত থাকবে এবং রাষ্ট্রপতি মহোদয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা নির্বাচনের জন্য একটি নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে, শেখ মুজিবুর রহমান পদত্যাগ করেন এবং “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” এর ধারা ৮ অনুযায়ী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।

পরবর্তীতে, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী “বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২” জারি করেন, যার মাধ্যমে একটি ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারী স্থানীয় দোসরদের বিচার করা।

ঘটনা :

অভিযোগকারী দুই ব্যক্তি ময়মনসিংহের একটি বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৮ আইন, যেটি “বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২” নামেও পরিচিত, এর অধীনে অভিযুক্ত হন। হাইকোর্ট বিভাগে বিচার চলাকালীন, তারা দাবি করেন যে ১৯৭২ সালের আদেশটি অবৈধ এবং এর অধীনে তাদের শাস্তি দেয়া উচিত নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে, আইনটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। হাইকোর্ট বিভাগ আদেশটিকে বৈধ বলে ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে, তারা আপিল বিভাগে একটি আপিল আবেদন দাখিল করেন।

ইস্যু :
১.বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২” কি বৈধ ছিল?
২.অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” এর অধীনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ কি বৈধ ছিল?
৩. স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে মনোনীত রাষ্ট্রপতির কি শাসন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রপতি শাসিত থেকে সংসদীয়/মন্ত্রীপরিষদ শাসিত ব্যবস্থায় রূপান্তরের সাংবিধানিক এখতিয়ার ছিল?

যুক্তিতর্ক :

বাদীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী যুক্তি উত্থাপন করেন যে, ‘বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২‘ ছিল অননুমোদিত কর্তৃপক্ষের দ্বারা জারিকৃত আইন, ফলে উক্ত আইন, একটি অবৈধ আইন। তিনি বলেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগও অবৈধ ছিল, কারণ, তাকে নিয়োগের আদেশটি পরবর্তীতে “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” দ্বারা বাতিল করা হয়েছিল। এই আদেশ সরকার ব্যবস্থাকে সংসদীয় গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিল, যা রাষ্ট্রপতির সংবিধান পরিবর্তন করার ক্ষমতাকে সীমিত করেছিলো।

বাদীপক্ষ আরও বলেন, অস্থায়ী সংবিধান আদেশ-টি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত মূল কাঠামোকে লঙ্ঘন করেছে। ১৯৭২ সালের “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ” অনুযায়ী, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কাঠামোতে এরূপ পরিবর্তন আনার কোনো প্রকার এখতিয়ার ছিল না।

বাদীপক্ষ এ বিষয়টিও উপস্থাপন করেন যে, “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” এর ৫ থেকে ৮ নাম্বার ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে, যা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাথে বিরোধপূর্ণ, যেখানে রাষ্ট্রপতির হাতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছিল। এর সূত্রধরে , তারা উল্লেখ করেন, সরকার কাঠামোর এই পরিবর্তন অবৈধ ছিল, ফলশ্রুতিতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগও অবৈধ ছিল। এর ফলস্বরূপ, তার (বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী-র) জারিকৃত সকল আইন ও আদেশ অবৈধ, যার মধ্যে “বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২” ও অন্তর্ভুক্ত ছিল, অতএব, এই আইনটিও অবৈধ।

সিদ্ধান্ত :

আপিল বিভাগ আপিল আবেদনটি খারিজ করে দেন। আদালত আবেদনকারীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে রায় দেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতিকে শুধু নির্বাহী ক্ষমতাই নয় বরং আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও প্রদান করা হয়েছিল। আইন প্রণয়নের এই ক্ষমতাটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, উক্ত ক্ষমতাই রাষ্ট্রপতিকে একটি অস্থায়ী সংবিধান গঠন করার সুযোগ দেয়, এবং এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” জারি করেন। আদালত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এরূপ কোন ধারা খুঁজে পান নি, যা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সরকার কাঠামোর পরিবর্তন আনার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে। ফলস্বরূপ, আদালত বলেন যে, ১৯৭২ সালের আদেশের ৫ থেকে ৮ ধারায় নির্ধারিত রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতার পরিবর্তন বৈধ এবং আদেশের ৮ ধারায় নতুন রাষ্ট্রপতির নিয়োগ আইনসিদ্ধ। অতএব, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিয়োগ যেহেতু বৈধ ছিল, তাই তাঁর জারিকৃত “বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২” -ও বৈধ ছিল।

সংশ্লিষ্ট আইন :

  1. অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২
    • ধারা : ৫ থেকে ৮
  2. বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২
  3. স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান

নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ

Share