রাষ্ট্র বনাম আঞ্জুয়ারা খাতুন (২০০৪)

State vs Anjuara Khatun (2004)

রাষ্ট্র বনাম আঞ্জুয়ারা খাতুন

সাইটেশন : 57 DLR HCD 277
Death Reference No. 43/2001

জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ

আবেদনকারী : রাষ্ট্র
বিবাদী : আঞ্জুয়ারা খাতুন

ঘটনা :

টিপু সুলতান ও তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা খাতুন একসাথে তাদের পারিবারিক বাড়িতে বসবাস করতেন। ঘটনার দিন, টিপু সুলতান গলায় কোদালের আঘাতে মারাত্মক আহত হন। ঘটনার পরপরই আঞ্জুয়ারা খাতুন বাড়ি থেকে পালিয়ে পাশের এক বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং তার এরূপ আচরণ উক্ত ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার তীব্র সন্দেহ সৃষ্টি করে। স্থানীয় সাক্ষীদের সহায়তায় তাকে আটক করা হলে তিনি তাদের [স্থানীয় সাক্ষীদের] নিকট [আইন দ্বারা স্বীকৃত নয় এরূপ] স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন যে, তিনি তার স্বামীকে [কোদাল দিয়ে] আঘাত করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করেন। মেডিক্যাল-আইন কর্মকর্তা, ডা. এম. শামসুল হাসান, মৃতদেহ পরীক্ষা করে নিশ্চিত করেন যে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড ছিল এবং আঘাতটির ধরণ অভিযোগকৃত অস্ত্রের [কোদালের] সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ছিল টিপু সুলতানের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, যা তিনি একটি ছোট কাগজের টুকরোতে লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বাংলায় লিখেছিলেন : “কোদাল দিয়া কোপ দেয় কিন্তু আমি জানিনি তোর ভাবি।” মৃতের ভাই তার হাতের লেখা শনাক্ত করে বয়ানের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

ইস্যু :
১. প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকলেও, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে আঞ্জুয়ারা খাতুনের দণ্ড বহাল রাখা আইনত গ্রহণযোগ্য ছিল কি না।
২. মৃতের দেয়া মৃত্যুকালীন জবানবন্দি (dying declaration) আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল কি না, এবং সেটি কি একমাত্র ভিত্তি হিসেবে দণ্ড প্রদানের জন্য যথেষ্ট ছিল।
৩. বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড কতটা ন্যায়সংগত ছিল, নাকি প্রশমক কারণ (mitigating factors) বিবেচনায় আজীবন কারাদণ্ডে রূপান্তর করা উচিত ছিল।

যুক্তিতর্ক :

রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি:
রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি দেন যে, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, উভয়ই আঞ্জুয়ারা খাতুনের দোষ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে। রাষ্ট্রপক্ষে এ বিষয়টি জোর দিয়ে উল্লেখ করেন যে, মৃত ব্যক্তির মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, যেখানে অভিযুক্তের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, তা সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ধারা ৩২ ও ৮০ অনুযায়ী আইনসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য। চিকিৎসা প্রতিবেদনও এটি নিশ্চিত করেছে যে মৃত্যুটি ছিল হত্যাজনিত। এছাড়াও ঘটনার পরপরই আঞ্জুয়ারা খাতুনের পালিয়ে যাওয়া এবং স্বামীর মৃত্যুর বিষয়ে ধারা ১০৬ অনুসারে ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হওয়া তার অপরাধের অনুমানকে আরও শক্তিশালী করে। পরবর্তীতে তার দেওয়া অসংগতিপূর্ণ বক্তব্যগুলোকে বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয়। সর্বোপরি, তথ্যগুলো এমন একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি তৈরি করে, যেটি কোনো যুক্তিসংগত সন্দেহের অবকাশ রাখে না।

বিবাদীপক্ষের যুক্তি:
বিবাদী পক্ষ যুক্তি দেন যে, আঞ্জুয়ারা খাতুন নির্দোষ এবং তার দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জোরপূর্বক আদায় করা হয়েছে। প্রত্যাহারকৃত বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন যে, জমি নিয়ে বিরোধের কারণে কিছু বহিরাগত তার স্বামীকে হত্যা করে এবং তাকে দোষ স্বীকারে বাধ্য করে। পরবর্তীতে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৩৪২ অনুযায়ী প্রদত্ত বিবৃতিতে ও জেল আপিলে তিনি বলেন, তার দেবর অ্যাডভোকেট আলতাফ হোসেন (PW 11) প্রকৃত হত্যাকারী, কারণ তিনি [আঞ্জুয়ারা খাতুন] তার [আলতাফ হোসেন] সঙ্গে বিবাহে রাজি না হওয়ায় আলতাফ হোসেন প্রতিশোধ নিতে উক্ত হত্যাকাণ্ড ঘটান। Cyril Waugh v. King [1950] AC 203 মামলার নজির দেখিয়ে বিবাদীপক্ষ মৃত্যুকালীন জবানবন্দিটি অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট উল্লেখ করে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এছাড়াও, ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না এবং আঞ্জুয়ারার মানসিক ও পারিবারিক অবস্থা বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান অতিরিক্ত কঠোর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ দণ্ড বলে তারা দাবি করেন।

সিদ্ধান্ত :

বিচারিক আদালত:
বিচারিক আদালত মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, স্বীকারোক্তি এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে আঞ্জুয়ারা খাতুনকে দণ্ডবিধির ধারা ৩০২ অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করেন। আদালত ঘটনাটিকে নৃশংস ও উদ্দেশ্যমূলক হত্যা হিসেবে বর্ণনা করে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

হাইকোর্ট বিভাগ:
হাইকোর্ট বিভাগ দণ্ড বহাল রাখলেও শাস্তি পরিবর্তন করেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন যে, মৃত্যুকালীন জবানবন্দিটি বিশ্বাসযোগ্য, স্বতঃস্ফূর্ত এবং চিকিৎসা প্রমাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আদালত আরও বলেন, জবানবন্দি সংক্ষিপ্ত হলেও তার প্রমাণমূল্য কমে না (State of Maharashtra v. Krishnamurti Laxmipati Naidu, AIR 1981 SC 617; Surajdeo Oza v. State of Bihar, AIR 1979 SC 1505) এবং এটিও উল্লেখ করেন যে, Cyril Waugh v. King [1950] AC 203 মামলার পরিস্থিতি উক্ত মামলার থেকে ভিন্ন। অবিচ্ছিন্ন পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ধারাবাহিকতাকে আদালত গ্রহণ করেন। তবে প্রশমক কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যে, আনজুয়ারা তিন সন্তানের মা, ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত নয়, এবং তার স্বামীর নির্যাতনমূলক আচরণ ছিল। এসব বিবেচনায় নিয়ে আদালত “rarest of rare” নীতি প্রয়োগ করে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তর করে, নিম্ন আদালতকে সংশোধিত রায় কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করেন।

সংশ্লিষ্ট আইন :

  1. দণ্ডবিধি, ১৮৬০
    • ধারা : ৩০২
  2. সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২
    • ধারা : ৩২, ৮০, ১০৬
  3. ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮
    • ধারা : ১৬৪, ৩৪২

অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান

নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ


Cite this Page:

OSCOLA

APA

Bluebook

Share