ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বনাম ফিরোজা বেগম ও অন্যান্য
সাইটেশন : 65 DLR (AD) 145
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
আপিলকারী : ঢাকা সিটি কর্পোরেশন
বিবাদী : ফিরোজা বেগম ও অন্যান্য
ঘটনা :
উক্ত মামলাটি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) পরিচালিত বিভিন্ন নগর উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত ৮৮ জন তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কিত। তাদের চাকুরি শুরু হয় ১৯৮৮ সালে স্লাম ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (বস্তি উন্নয়ন প্রকল্প) এর মাধ্যমে, যেখানে সরকারি নথিতে উল্লেখ ছিল যে, পরবর্তীতে কমিউনিটি সংগঠকদের নিয়মিত পৌর কর্মচারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পরবর্তীতে এদের অনেককে ১৯৯৬ সালে আরবান বেসিক সার্ভিস ডেলিভারি প্রজেক্টে এবং ১৯৯৮ সালে লোকাল পার্টনারশিপস ফর আরবান পোভার্টি অ্যালিভিয়েশন প্রজেক্টে নেওয়া হয়।
যদিও এসব পদ সাময়িকভাবে দেওয়া হয়েছিল, আবেদনকারীগণ টানা ১০ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত উক্ত পদে কাজ করে গেছেন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত সহ বিভিন্ন সরকারি সিদ্ধান্ত এবং ডিসিসির নিজস্ব পদক্ষেপ, যেমন-টাইম স্কেল সুবিধা প্রদান, ইঙ্গিত দেয় যে আবেদনকারীদের রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু ডিসিসি আবেদনকারীদের চাকুরিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং জুন ২০০৭ এর পরও তাদের প্রাপ্য বেতন প্রদান করেনি। আইনি নোটিশ ও বৈঠকের পরও কোনো ফলাফল না পাওয়ায়, আবেদনকারীরা ২০০৮ সালের রিট আবেদন নম্বর ৯৬৭৫ দায়ের করেন, যা হাইকোর্ট বিভাগ মঞ্জুর করেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আপিল দায় করা হয়।
ইস্যু :
১. ধারাবাহিক প্রকল্পের অধীনে চাকরির ধারাবাহিকতা কি আবেদনকারীদের ডি.সি.সি.-এর রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার সৃষ্টি করে?
২. আবেদনকারীদের রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা কি আইনের চোখে একটি ‘বৈধ প্রত্যাশা’ (legitimate expectation) হিসেবে গণ্য হয়?
৩. বকেয়া বেতন ও অন্যান্য সুবিধাসহ রিট আবেদনকারীদের রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ডি.সি.সি.-কে নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট কি আইনে ভুল করেছিলেন ?
যুক্তিতর্ক :
আপিলকারী পক্ষের যুক্তি :
আপিলকারীগণ যুক্তি দেন যে, রিট আবেদনকারীগণ ছিলেন চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী, যাদের চাকুরি, প্রকল্প সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। এটি তাদের নিয়োগপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। তারা আরও যুক্তি দেন যে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, যা ২০০৮ সালের অধ্যাদেশ এবং ২০০৯ সালের আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রিত, তার অনুমোদিত অর্গানোগ্রামের বাইরে কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত করার কোনো ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং, আবেদনকারীদের ধারাবাহিক চাকুরি কোনো আইনগত অধিকার বা বৈধ প্রত্যাশা সৃষ্টি করে না। আপিলকারীগণ দাবি করেন যে, একে বৈধ প্রত্যাশার বিষয় হিসেবে গণ্য করে এবং তাদের বকেয়া বেতন ও সুবিধাসহ অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ আইনি ভুল করেছেন।
বিবাদী পক্ষের যুক্তি:
বিবাদীপক্ষ যুক্তি দেন যে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (এলজিআরডি) বিভিন্ন সরকারি চিঠি এবং একনেক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বারবার তাদের আশ্বাস দিয়েছে যে, তারা রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তারা ১০ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত ডি.সি.সি.-তে কাজ করেছেন, স্থায়ী কর্মচারীদের জন্য সাধারণত দেওয়া টাইম-স্কেল সুবিধা পেয়েছেন এবং ডি.সি.সি.-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করেছেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তারা ডি.সি.সি.-এর রাজস্ব কাঠামোর অধীনে স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বৈধ ও যৌক্তিক প্রত্যাশা তৈরি করেছিলেন।
সিদ্ধান্ত :
হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত :
হাইকোর্ট বিভাগ রিট আবেদনকারীদের ডি.সি.সি.-এর রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বকেয়া বেতন ও সুবিধা প্রদান করার নির্দেশ দেন।
আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত:
|আপিল বিভাগ আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন। আদালত মনে করেন, উক্ত আপিলে হস্তক্ষেপ করার মতো কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, কারণ হাইকোর্ট বিভাগ যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ করেছেন এবং সঠিকভাবে তথ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আদালত পর্যবেক্ষণ করেন যে, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও সরকার উভয়েই দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বারবার একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েছে। আদালত রায় দেন যে, আবেদনকারীদের রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বৈধ প্রত্যাশা ছিল, যা পুনঃপুন আশ্বাস, সরকারি চিঠিপত্র, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত এবং টাইম-স্কেল সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে প্রমাণিত। বৈধ প্রত্যাশা নীতির পঞ্চম নীতি প্রয়োগ করে আদালত বলেন, আবেদনকারীরা এসব প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করেছিলেন, এবং তাদের অন্তর্ভুক্তি অস্বীকার করা হলে তা অবিচার ও ক্ষতির কারণ হবে। অতএব, হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইনি নীতি :
বৈধ প্রত্যাশার নীতি: বৈধ প্রত্যাশার নীতি প্রশাসনিক আইনের একটি নীতি, যা ব্যক্তি বিশেষকে হঠাৎ বা অন্যায়ভাবে সরকারি নীতি বা সিদ্ধান্তের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, বিশেষ করে যখন তারা পূর্বের কর্মকাণ্ড, প্রতিশ্রুতি বা সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠিত চর্চার উপর ভিত্তি করে কোনো নির্দিষ্ট আচরণের প্রত্যাশা করে থাকেন। তবে কিছুক্ষেত্রে বৈধ প্রত্যাশা কেবল বৈধ জনস্বার্থের কারণে অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে বৈধ কারণ বা জনস্বার্থের ভিত্তি দেখিয়ে বৈধ প্রত্যাশা নাকচ করার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অনুবাদক :
১ . মো. আতিকুর রহমান
[সতর্কতা : উক্ত মামলার বাংলা সংস্করণটি মূল ইংরেজি হতে অনূদিত। অর্থগত সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কোনো প্রকার অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হলে, মূল ইংরেজি সংস্করণ প্রাধান্য পাবে।]
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ