মো. আবু বকর সিদ্দিক বনাম এস.এম.এ. বকর এবং অন্যান্য
রেফারেন্স : 38 DLR (AD) [1986] 106
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
বাদী : মো. আবু বকর সিদ্দিক
বিবাদী : এস.এম.এ. বকর
ঘটনা :
বাদী মো. আবু বকর সিদ্দিক ১৯৭৩ সালে বিবাদী এস.এম.এ বকরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৬ সালে তাদের পুত্র সন্তান, সুজা, জন্মগ্রহণ করেন। সুজা’র পিতা, মো. আবু বকর সিদ্দিক ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং মাতা, এস.এম.এ বকর ছিলেন একজন এমবিবিএস চিকিৎসক। ১৯৭৭ সালে সন্তানকে (সুজাকে) বাদীর (সন্তানের পিতার) নিকট রেখে, বিবাদী পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যান। ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন কিন্তু দুই মাস পর সন্তানকে সাথে নিয়ে পুনরায় সৌদি আরব ফিরে যান। পরবর্তীতে বাদী নিজেও সৌদি আরব যান এবং ১৯৮১ সালে সুজাকে তার মায়ের নিকট রেখেই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৮২ সালে বিবাদী বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন এবং এর প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৮৪ সালে বিবাদী বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং তার সন্তানকে (সুজাকে) আত্মীয়স্বজনের নিকট রেখে পুনরায় সৌদি আরব ফিরে যান।
এমতাবস্থায়, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ এর ধারা ২৫ এর অধীনে মো. আবু বকর সিদ্দিক তার সন্তান সুজাকে নিজ হেফাজতে রাখার দাবি করেন। এরমধ্যে, সুজা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার মায়ের তত্ত্বাবধানে যুক্তরাজ্যে তার অস্ত্রোপচার করানো হয় এবং পরবর্তীতে আরো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তার সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়।
পিতার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং হানাফি আইনের অধীনে সাত বছরের বেশি বয়সী পুত্রের হেফাজতের দায়িত্ব পিতার নিকট যাওয়া সত্ত্বেও মা-এর কার্যকলাপ সুজার সার্বিক কল্যাণের বিষয়টিই প্রকাশ করে। তিনি তার সন্তানের দেখভালের জন্য নিজের চাকরি ছেড়ে চলে আসেন এবং একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি সুজার শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য যোগ্য।
ইস্যু :
১. ইসলামি আইন মোতাবেক বাদীর কি সুজার উপর হেফাজতের অধিকার রয়েছে?
২. সন্তানের প্রতি পিতার হেফাজতের অধিকার কি সন্তানের কল্যাণ, শারীরিক অবস্থা এবং মাতৃ সংস্পর্শে থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তিতর্ক :
- বাদী মো. আবু বকর সিদ্দিকের পক্ষে, বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব ফজলুল করিম বলেন, যেহেতু বাদী একজন প্রকৌশলী সেহেতু তিনি সুজার সমস্ত চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে সক্ষম। বাদী ইতোমধ্যে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণও করেছেন। তদুপরি, হানাফি মাযহাব অনুযায়ী, সুজার বয়স সাত বছরের ঊর্ধ্বে হওয়ায় হেফাজতের অধিকার ধর্মীয় আইন মোতাবেক বাদীর উপর বর্তায়। ইসলামি আইনের আলোকে সন্তানের হেফাজতের ক্ষেত্রে পিতার অধিকার প্রথমে থাকে। এছাড়াও, বিজ্ঞ আইনজীবী আরও উল্লেখ করেন যে, যদি বিবাদীকে হেফাজতের অধিকার প্রদান করা হয়, এবং বিবাদী অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সেক্ষেত্রে বিষয়টি সন্তানের অধিকার নিশ্চিতে সমস্যার উদ্ভব ঘটাতে পারে।
- পক্ষান্তরে, বিবাদী এস.এম.এ বকরের পক্ষে, আইনজীবী মো. নুরুল হক বলেন, বিবাদী সন্তানের পূর্ণ যত্ন নিয়েছেন এবং অস্ত্রোপচারের সময় সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যয় বহন করেছেন, যেখানে বাদী কোনো প্রকার চিকিৎসা ব্যয় বহন করেননি। সন্তানের কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে, বিবাদী তার উচ্চ বেতনের চাকুরিও ত্যাগ করেছেন। উল্লেখ্য, যখন সন্তানের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সে কার সঙ্গে থাকতে চায়, তখন সে তার বাবার পরিবর্তে মায়ের সঙ্গে থাকাকে বেছে নেয়েছিলো। বিজ্ঞ আইনজীবী এটিও উল্লেখ করেন যে, মা একজন এমবিবিএস চিকিৎসক এবং অসুস্থ সন্তানের সঠিক যত্ন কীভাবে নিতে হবে তা তিনিই সবচেয়ে ভালো জানবেন।
সিদ্ধান্ত :
উভয় পক্ষের শুনানির পর, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ রায় প্রদান করেন যে, যদিও পিতার অভিভাবকত্ব/হেফাজত সম্পর্কিত ইসলামি আইন এখানে প্রয়োগ করা যেতে পারে, তবে সন্তানের কল্যাণই এখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। আদালত আপিল খারিজ করেন এবং মায়ের কাছে হেফাজতের অধিকার হস্তান্তর করেন। উক্ত মামলায় এটি বিবেচ্য বিষয় ছিল যে, মা, যিনি একজন চিকিৎসক, বাবার চেয়ে তিনিই সন্তানের যত্ন নিতে বেশি সমর্থ। অধিকন্তু, সন্তানের যত্নে মায়ের প্রচেষ্টা ও ত্যাগ এবং সন্তানের তার মায়ের সাথে থাকার ইচ্ছা, আদালতকে পিতার অধিকারের চেয়ে সন্তানের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
❝সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ❞ নীতি :
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত বিষয় হিসেবে উক্ত মামলাটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা। মামলাটি বাংলাদেশে ❝সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ❞ নামক একটি নীতি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। এ নীতি অনুযায়ী, সন্তানের অভিভাবকত্ব বা হেফাজত প্রদানের ক্ষেত্রে সন্তানের কল্যাণই সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা হবে।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০
- ধারা : ২৫
অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান
২. ফাহিম আহমেদ
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ