বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি. বনাম রওশন আখতার ও অন্যান্য
রেফারেন্স – ১ : 62 DLR (HCD) (2010) 483
রেফারেন্স – ২ : 69 DLR (AD) (2017) 196
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
বাদী : রওশন আখতার
বিবাদী : বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি.
ঘটনা :
মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একই সাথে তিনি ছিলেন, একজন সম্প্রচারক, নাট্যকার এবং কবি। ৩রা ডিসেম্বর ১৯৮৯ তারিখে সিগারেট কিনে রাস্তা পার হওয়ার সময় কাকরাইলে অবস্থিত ‘আনন্দ ভবন’ এর সামনে, বিপরীত দিক থেকে আসা ‘বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি.’ এর একটি মিনি ভ্যানের আঘাতে গুরুতর আহত হন। আঘাতের ফলে তার মুখের হাড় ও মাথার খুলি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যায়। গুরুতর এই আঘাতই তার মৃত্যুর কারণ বলে চিকিৎসক জানান। মৃত্যুর সময় জনাব মন্টুর বয়স হয়েছিলো আনুমানিক ৪৪ বছর, তিনি দুজন নাবালক সন্তান, স্ত্রী, পিতামাতা, একজন ভাই এবং একজন বোন রেখে যান।
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের ০১ জানুয়ারি, নিহতের স্ত্রী, রওশন আখতার, ঢাকা দায়রা জজ আদালতে একটি ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করেন। মার্চ ২০০৫ এ দায়রা জজ আদালত বাদীর পক্ষে রায় দেন এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন। ‘বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি.’ উক্ত রায়ের বিপক্ষে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করেন। হাইকোর্ট বিভাগ ২০১০ সালে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কমিয়ে, বাদী রওশন আখতারের পক্ষেই রায় প্রদান করেন। ‘বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি.’ পুনরায় আপিল বিভাগে আপিল করে। আপিল বিভাগ ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে ২০১৬ সালে রওশন আখতারের পক্ষে রায় প্রদান করেন।
সিদ্ধান্ত : জেলা ও দায়রা জজ আদালত
বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে বিবাদী পক্ষ থেকে একজন সাক্ষী উপস্থাপন করা হলে তিনি বলেন, চালক রাস্তার সঠিক পাশে গাড়িটি চালাচ্ছিলো এবং ‘নিহত’ সাংবাদিক ঐ মুহূর্তে উল্টো রাস্তায় হাঁটছিলেন, যার ফলে দুর্ঘটনাটি সংঘটিত হয়। কিন্তু বিবাদী পক্ষ থেকে উপস্থাপিত সাক্ষীর বক্তব্য ‘ক্রস এক্সামিনেশন’ এর সময় মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে উক্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হলে তারা বাদীর পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। এর প্রেক্ষিতে বিচারক বলেন, ❝যেহেতু চালক ‘বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি. এর একজন কর্মচারী এবং সে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে কর্মে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় সেহেতু ‘বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি.’ ‘পরার্থভাবে দায়ী’❞ বিচারক মোট ৬ টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
- ‘প্রধান উপার্জনক্ষমের ক্ষতিসাধন’ এর উপর ভিত্তি করে ১৯,০৭,০০৮ টাকা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
- ‘ নিহতের সন্তানগণ, পিতৃস্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে’ এ বিষয়ের উপর ভিত্তিকরে ২,০০,০০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
- ‘নিহতের স্ত্রী, স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে’ এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ১,০০,০০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
- ‘অবসরকালীন ভাতা’ এর উপর ভিত্তি করে ৩২,৪০,০০০ টাকা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
- ‘নিহতের পিতার সন্তান কর্তৃক সদিচ্ছা পূরণ’ এর উপর ভিন্ন করে ৫০,০০০ টাকা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
- ‘নিহতের পরিবারের মানসিক ক্ষতি’ এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ১,০০,০০০ টাকা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
আদালত (জেলা ও দায়রা জজ আদালত) সর্বমোট ৩,৫২,৯৭,০০৮ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
সিদ্ধান্ত : হাইকোর্ট বিভাগ
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ‘বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ড্রাট্রিজ লি.’ হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করে। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি শরিফউদ্দিন চাকলাদার এবং বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান উক্ত মামলাটি পরিচালনা করেন। বিজ্ঞ বিচারকগণ ৫ নং পয়েন্ট (নিহতের পিতার সন্তান কর্তৃক সদিচ্ছা পূরণ) এবং ৬নং পয়েন্ট (নিহতের পরিবারের মানসিক ক্ষতি) কে “অস্পষ্ট ও অযৌক্তিক” বলে ঘোষণা করেন। ফলে, ৫ ও ৬ নং পয়েন্টকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়া হয়। এরপর বিজ্ঞ বিচারকগণ ২নং পয়েন্ট (নিহতের সন্তানগণ, পিতৃস্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে) এবং ৩নং পয়েন্ট (নিহতের স্ত্রী, স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে) পর্যালোচনা করে উক্ত দুই পয়েন্টে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কমান। ২ এবং ৩ নং পয়েন্টে উল্লিখিত ক্ষতিপূরণকে সম্মিলিতভাবে ১,৫০,০০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ করার নির্দেশ দেন।
হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী সর্বমোট ক্ষতিপূরণ ২,০১,৪৭,০০৮ টাকা প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়।
সিদ্ধান্ত : আপিল বিভাগ
হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিপক্ষে ‘বাংলাদেশ ব্রেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিস লি.’ পুনরায় আপিল বিভাগে আপিল করে। আপিল বিভাগে, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হুসাইন হায়দার এবং বিচারপতি মাহমুদ হোসেন মামলাটি পরিচালক করেন। আপিল বিভাগ, ২নং এবং ৩নং পয়েন্টের উপর হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কমিয়ে দেন। ফলে, উক্ত পরিমাণ ১,৫০,০০,০০০ টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ১,২০,০০,০০০ টাকা হয়।
সর্বশেষ, মোট ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কমে ১,৭১,৪৭,০০০৮ টাকায় দাঁড়ায়।
অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান
২. ফাহিম আহমেদ
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ