সিসিবি ফাউন্ডেশন বনাম বাংলাদেশ এবং অন্যান্য
রেফারেন্স : 5 CLR (HCD) (2017)
জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ
বাদী : চিলড্রেনস চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (সিসিবি ফাউন্ডেশন)
বিবাদী : বাংলাদেশ এবং অন্যান্য (উল্লেখ্য – বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স, বাংলাদেশ রেলওয়ে, এবং ঢাকা ওয়াসা)
ঘটনা :
২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ৪ বছর বয়সী শিশু জিহাদ ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে খেলতে গিয়ে একটি খোলা শ্যাফটে (কুয়া) পড়ে যায়। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক নিযুক্ত ঠিকাদার কর্তৃক উক্ত শ্যাফটটি খোলা ও অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল। যদিও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু করে, তবে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের যথাযথ দক্ষতা ও প্রযুক্তি ছিল না। তারা জিহাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য শ্যাফটের ভিতরে একটি ক্যামেরা পাঠায়। কিন্তু ক্যামেরাটিও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। শিশুটিকে উদ্ধারের কোনো কার্যকর প্রচেষ্টা না করে তারা অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আরেকটি ক্যামেরা নিয়ে আসে। এই ধরনের “পর্যবেক্ষণ” ১০-১২ ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে। এরপর তারা উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেন এবং গণমাধ্যমকে জানায় যে শ্যাফটে কেউ আটকা নেই। তবে তাদের চলে যাওয়ার পর, একটি স্বেচ্ছাসেবক দল নিজেদের তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করে শ্যাফট থেকে জিহাদের মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
সিসিবি ফাউন্ডেশন একটি রিট পিটিশন দায়ের করে যা জনস্বার্থ মামলা (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন) হিসাবে গৃহীত হয় এবং সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি রুল জারি করা হয়। রুলে বিবাদীপক্ষকে, কেন জিহাদের উদ্ধারকাজে অবহেলা/গাফিলতি অবৈধ এবং সংবিধানের ৩১, ৩২ এবং ৩৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন বলে ঘোষণা করা হবে না এবং কেন জিহাদের পরিবারকে ৩০,০০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তার কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
রুল অনুসারে, প্রতিটি বিবাদী তাদের পক্ষের লিখিত জবাব জমা দেয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দাবি করে যে, এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল এবং তাদের কর্মীরা এমন উদ্ধার অভিযানে অভ্যস্ত নয় এবং তাদের কাছে এ ধরনের অভিযানে ব্যবহৃত উন্নত ক্যামেরা ছিল না। তারা আরও দাবি করে যে, তাদের সীমাবদ্ধতার পরও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, তাই তাদের কাজে কোন প্রকার গাফিলতি বা অবহেলা ছিল না। বাংলাদেশ রেলওয়ে দাবি করে যে, শ্যাফটটি একটি তৃতীয় পক্ষের ঠিকাদার কর্তৃক অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল, উক্ত ঠিকাদারকে দুর্ঘটনার পরই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ইস্যু :
১. উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিসিবি ফাউন্ডেশনের পিটিশন দায়েরের লোকাস স্ট্যান্ডি (অভিযোগ দায়েরের অধিকার) ছিল কি?
২. জিহাদের মৃত্যু কি বাদীপক্ষের অবহেলার কারণে ঘটেছিল?
৩. রিটের মাধ্যমে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক বা আইনগত দায়িত্ব লঙ্ঘনের কারণে ক্ষতিপূরণের দাবি করা যায় কি?
৪. এরূপ ঘটনায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কীভাবে নির্ধারণ করা যায়?
সিদ্ধান্ত :
হাইকোর্ট বিভাগ রায় প্রদান করেন যে, সিসিবি ফাউন্ডেশনের লোকাস স্ট্যান্ডি (মামলা করার আইনি অধিকার) রয়েছে, কারণ উক্ত ঘটনা গুরুতর জনস্বার্থ বিষয়ক ক্ষতি এবং সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের সাথে সম্পর্কিত। আদালত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং বাংলাদেশ রেলওয়েকে তাদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য দায়ী বলে অভিহিত করেন। উক্ত মামলায় “res ipsa loquitur” এবং কঠোর দায়বদ্ধতার (strict liability) নীতি প্রয়োগ করা হয়, কারণ অভিযুক্ত পক্ষের উক্ত দুর্ঘটনা ঘটনার কারণগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, “উক্ত ঘটনা নিজেই ‘অবহেলার ফলে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে’ এরূপ যুক্তিসংগত প্রমাণ গঠন করে।”
আদালত ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততার দাবি খারিজ করে দিয়ে বলেন, “তাদের উক্ত বিষয়টিতে সঠিক দক্ষতা ছিল না এরূপ দাবি কখনোই তাদের উপর আরোপিত জনস্বার্থের দায়িত্ব ও আইনি দায় থেকে মুক্তি দিতে পারে না।” বাংলাদেশ রেলওয়েকে তাদের নিয়োগকৃত ঠিকাদারের অবহেলার জন্য কঠোরভাবে দায়বদ্ধ (strictly liable) বলে গণ্য করা হয়। তবে, ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করা হয়নি, কারণ তারা শ্যাফটের রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জড়িত ছিল না এবং উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য তাদের কোনো আইনি দায়বদ্ধতাও ছিল না।
হাইকোর্ট বিভাগ, সংবিধানের ৪৪(১) এবং ১০২(১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার প্রদান করার বিষয়ে আদালতের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে, প্রতিকারের ধরন নির্ধারণ করার ক্ষমতা আদালতের বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। কিছু বাংলাদেশি এবং ভারতীয় মামলার পাশাপাশি সংবিধানের অনুচ্ছেদ উদ্ধৃতি করে আদালত সিদ্ধান্ত দেন যে, কোন সরকারি কর্তৃপক্ষের দ্বারা বিধিসংগত/সাংবিধানিক দায়িত্ব লঙ্ঘনের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানে আদালতের ক্ষমতার উপর কোনো প্রকার বাধা নেই। বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বনাম রওশন আক্তার [62 DLR (HCD) (2010) 483] মামলায় গৃহীত সিদ্ধান্তকে উল্লেখ করে বলা হয় যে, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হিসাবের ভিত্তিতে নয় বরং সামষ্টিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
জিহাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং বাংলাদেশ রেলওয়েকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জিহাদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে সর্বমোট ২০ লক্ষ টাকা দেওয়ার আদেশ প্রদান করা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইন :
- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
- অনুচ্ছেদ : ৪৪(১), ১০২(১)
অনুবাদক :
১. মো. আতিকুর রহমান
নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ