হেফজুর রহমান বনাম শামসুন নাহার বেগম (১৯৯৮)

Hefzur R v Shamsun N Case FP BN

হেফজুর রহমান (মো.) বনাম শামসুন নাহার বেগম এবং অন্যান্য

রেফারেন্স : 51 DLR (AD) 172

জুরিসডিকশন : বাংলাদেশ

আপিলকারী : হেফজুর রহমান (মো.)
বিবাদী ১ : শামসুন নাহার বেগম
বিবাদী ২ : শাওন মিয়া

ঘটনা :

শামসুন নাহার বেগম তার নাবালক পুত্র শাওন মিয়াকে নিয়ে পারিবারিক আদালতে তার প্রাক্তন স্বামী হেফজুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, বিবাহের সময় হেফজুর রহমান যৌতুক গ্রহণ করেছিলেন, তার আগের বিয়ের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন, কাবিননামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি মোট দেনমোহরের ৫০,০০১ টাকার মধ্যে ২,০০০ টাকা আগেই পরিশোধ করেছেন, শামসুন নাহারকে শারীরিক নির্যাতন করে গর্ভাবস্থায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন এবং তালাকের আগে ও পরে মা ও ছেলের জন্য কোনো ভরণপোষণ দেননি। উক্ত অভিযোগের লিখিত জবাবে হেফজুর রহমান দাবি করেন, শামসুন নাহার তার আগের স্ত্রীর সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন। তিনি আরও দাবি করেন যে, দেনমোহরের ২,০০০ টাকা তিনি পরিশোধ করেছেন এবং মা ও ছেলের ভরণপোষণের জন্য নিয়মিত মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছেন। তিনি যৌতুক নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং পাল্টা অভিযোগ করেন যে শামসুন নাহার অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন; তবে তিনি স্বীকার করেন যে শাওন মিয়া তার নিজের পুত্র।

পারিবারিক আদালত হেফজুর রহমানকে ৮৯,০০০ টাকা পরিশোধের আদেশ দেন, যার মধ্যে তালাক-পরবর্তী ইদ্দতকালীন (৩ মাস) ভরণপোষণ, ছেলে শাওন মিয়ার ভরণপোষণ এবং বকেয়া দেনমোহরের অর্থ অন্তর্ভুক্ত ছিল। জেলা জজ আদালত এই পরিমাণ কমিয়ে ৭২,৬০০ টাকা নির্ধারণ করেন। পরবর্তীতে হেফজুর রহমান সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে উক্ত রায়ের পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকমণ্ডলী নিজেরা সিদ্ধান্ত নেন যে, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী শামসুন নাহার বেগম পুনরায় বিয়ে করা বা মৃত্যু হওয়ার মাধ্যমে তালাকপ্রাপ্তের মর্যাদা না হারানো পর্যন্ত তাকে তালাক-পরবর্তী ভরণপোষণ দিতে হবে। উল্লেখ্য, শামসুন নাহার বেগম মামলায় কোথাও ইদ্দতকাল অতিক্রম হওয়ার পরের ভরণপোষণের দাবি করেননি, এবং মুসলিম নারীরা পুনর্বিবাহ পর্যন্ত তালাক-পরবর্তী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী কি না, এই প্রশ্নও পুরো বিচারপ্রক্রিয়ার কোনো বিষয়বস্তু ছিল না।

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকমণ্ডলী এই বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যদিও এই সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে হেফজুর রহমানের বক্তব্য শোনা হয়নি। বিচারকমণ্ডলী ইসলামি আইনের পাণ্ডিত্য রয়েছে এমন কোন ব্যক্তির নিকট হতে কোন পরামর্শ নেন নি এবং পবিত্র কোরআনের ২য় সূরার ২৪১ নাম্বার আয়াতের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে রায় প্রদান করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হয়।

ইস্যু :
১. বিচারকমণ্ডলী কি মামলার বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে স্বপ্রণোদিতভাবে (suo motu) কোনো বিষয় উত্থাপন ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন?
২. পবিত্র কুরআনের ২য় সূরার ২৪১ নাম্বার আয়াতে উল্লিখিত “মাতা” শব্দটিকে কি “ভরণপোষণ” হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে?
৩. বিচারকমণ্ডলী কি ইসলামি চিন্তাবিদদের প্রচলিত ব্যাখ্যা উপেক্ষা করে নিজের মতো কুরআনের আয়াতের আইনি বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারেন?
৪. একজন মুসলিম নারী কি, তালাক-পরবর্তী ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরও, তালাকপ্রাপ্ত হিসেবে তার পরিচয় হারানোর আগ পর্যন্ত ভরণপোষণের অধিকার পেতে পারেন?

সিদ্ধান্ত :

আপিল বিভাগ উল্লেখ করেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকমণ্ডলীর স্বপ্রণোদিত হয়ে এরূপ প্রশ্ন উত্থাপনের কোন এখতিয়ার নেই, যা কোন পক্ষের আবেদনে উল্লেখ করা হয়নি এবং তাঁরা হেফজুর রহমানের আত্মপক্ষে যুক্তিতর্ক না শুনে কখনোই এরূপ করতে পারেন না। বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেছেন, ❝হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলীর কোনো এখতিয়ার নেই যে তারা তাদের ব্যক্তিগত মতামত আপিলকারী ওপর আরোপ করবেন, যা তার জন্য অতিরিক্ত ব্যয় ও দায় তৈরি করে। স্বপ্রণোদিতভাবে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য, কারণ এটি আপিলকারী অনুপস্থিতিতে করা হয়েছে এবং তাকে কোনো প্রকার অবহিত না করে এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো, অন্যথায় আপিলকারী বিচারকমণ্ডলীর ব্যক্তিগত মতামত খণ্ডন করার সুযোগ পেতেন।❞

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকমণ্ডলী পবিত্র কুরআনের ২য় সূরার ২৪১ নাম্বার আয়াতে উল্লিখিত ‘মাতা’ শব্দটির অর্থ “ভরণপোষণ” (maintenance) হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যা প্রদানকালে তারা এ বিষয়ে অন্যান্য আয়াত, বিভিন্ন অনুবাদ এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদদের ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করেননি। আপিল বিভাগ বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদদের মতামতের ভিত্তিতে “মাতাউন বিল মারুফ” শব্দটিকে-কে “যৌক্তিক পরিমাণের একটি উপহার” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা তালাকপ্রাপ্ত নারীর জন্য ঐচ্ছিক সান্ত্বনামূলক উপহার হিসেবে বোঝায়, “বাধ্যতামূলক ভরণপোষণ” হিসেবে নয়।

হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের সমালোচনা করে আপিল বিভাগ বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া নিজেরা কুরআনের আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে এবং ইসলামি আইনবিদদের ১৪০০ বছরের গবেষণাকে উপেক্ষা করেছেন। পূর্বে সমাধান হওয়া একটি ইসলামি আইন নিয়ে পুনরায় বিতর্ক করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই বলে জানান। বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেন, ❝আমাদের মতে, পবিত্র কুরআনের পুনরায় ব্যাখ্যা করা বা ইজমা দ্বারা নিষ্পত্তি হওয়া কোনো বিষয়ে পুনরায় প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত থাকা উচিত : (১) পুনর্ব্যাখ্যার জন্য একটি বৈধ কারণ বা কারণসমূহ থাকা (২) এটি অবশ্যই পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহর ভিত্তিতে হতে হবে এবং যারা উক্ত ব্যাখ্যা করবেন তাদের অবশ্যই এর জন্য উপযুক্ত হতে হবে।❞

তালাক-পরবর্তী ভরণ-পোষণ প্রশ্নে আপিল বিভাগ রায়  প্রদান করেন যে, একজন মুসলিম নারী তার ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পর আর কোনো ভরণ-পোষণের অধিকার রাখেন না। মুসলিম বিবাহ একটি চুক্তিগত সম্পর্ক, তাই চুক্তির সমাপ্তির পর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো অধিকার বা দায়িত্ব বহাল থাকে না। একই সাথে, হাইকোর্ট বিভাগের বিতর্কিত রায়টি বাতিল করা হয়।

আইনি নীতি :
একজন তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারী তার প্রাক্তন স্বামীর নিকট হতে ইদ্দত কাল (৩ মাস) পর্যন্ত ভরণ-পোষণ পাওয়ার অধিকার রাখেন। যদি তালাকের সময় তিনি গর্ভবতী থাকেন আর সন্তানের জন্ম হতে ৩ মাসের বেশি সময় লাগে, তবে সন্তানের জন্ম পর্যন্ত তিনি ভরণ-পোষণ পাওয়ার অধিকার রাখেন।

সংশ্লিষ্ট আইন :

  1. মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন, ১৯৩৭
  2. মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১
  3. পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫
  4. দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮

অনুবাদক :
১. ফাহিম আহমেদ
২. মো. আতিকুর রহমান

নোট : The Case Summary আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এবং আইনের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঘটনা ও রায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই প্ল্যাটফর্মটি কখনোই পূর্ণাঙ্গ আইনের ধারণা প্রদান করে না, আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু মাত্র মামলার সারাংশ নির্ভর হওয়াকে নিরুৎসাহিত করি। ধন্যবাদ

Share